নিকি বলল, কিন্তু মিক্কু তো কাপড় পরে না।
মিক্কু মোটেও সভ্য প্রাণী নয়। মিক্ক একটি বানর। কিকি কাপড় পরে না! কিকি একটি পাখি।
নিকির চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি কোনো কাপড় পর না।
আমি একটি যন্ত্র। যন্ত্রদের কাপড় পরতে হয় না। তুমি মানুষ তোমাকে কাপড় পরতে হবে। সবসময় অন্ততপক্ষে কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ডেকে একটি কাপড় পরতে হবে।
নিকি যুক্তিতর্কে সুবিধে করতে না পেরে অন্যপথে গেল। মুখ শক্ত করে বলল, আমি মানুষ হতে চাই না।
ক্রিনিটি বলল, না চাইলেও কিছু করার নেই, তুমি এখন অন্য কিছু হতে পারবে না। তোমাকে মানুষ হয়েই থাকতে হবে।
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, কেন মানুষ হলে কাপড় পরতে হবে?
মানুষ সভ্য প্রাণী। যখন তোমার সাথে অন্য মানুষের দেখা হবে তখন তোমার শরীরে কাপড় না থাকলে তারা তোমাকে অসভ্য ভাববে।।
নিকি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। যদি আমার সাথে কখনো অন্য মানুষের দেখা হয় তখন আমি দৌড় দিয়ে কাপড় পরে নেব।
ক্রিনিটি বলল, না। কাপড় পরা একটি অভ্যাসের ব্যাপার। যার সেই অভ্যাস নেই সে কখনো দৌড়ে কাপড় পরতে পারবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জান?
কী?
মানুষের সাথে কোনোদিন দেখা হোক বা না হোক তোমাকে কাপড় পরে থাকতে হবে।
নিকি মুখ গোঁজ করে বলল, কেন?
তোমার মা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমাকে বলেছে আমি যেন তোমাকে দেখে শুনে রেখে বড় করি। সেজন্যে আমার তোমাকে ঠিক করে বড় করতে হবে। সভ্য মানুষের মতো বড় করতে হবে।
নিকি এবার দুর্বল হয়ে পড়ল। তার মা-কে সে খুব ভালোবাসে। ক্রিনিটির কাছে তার মায়ের যে হলোগ্রাফিক ছবি আছে সে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, অনেকবার সে তার মা-কে ধরতে গিয়ে দেখেছে সেটি সত্যি নয়। তার খুব ইচ্ছে করে একদিন সে ধরতে গিয়ে দেখবে সেটি সত্যি তখন তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। ক্রিনিটি তাকে বলেছে যে এটি কখনো হবে না, তবুও সে আশা করে আছে যে কোনো একদিন হয়তো এটি হয়ে যাবে।
নিকি ঘরের ভেতর ফিরে গেলো, এক টুকরো কাপড় নিয়ে সেটি তার। কোমরে বেঁধে নিল, তারপর ক্রিনিটিকে বলল, এখন আমি বাইরে যাই?
যাও।
নিকি দরজা খুলে বাইরে যেতেই কক কক শব্দ করে একটি পাখি তার দিকে উড়ে আসে, তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে সেটি তার ঘাড়ে বসার চেষ্টা করতে থাকে। নিকি তার হাতটি বাড়িয়ে দিতেই পাখিটি সেখানে বসে নিকির দিকে তাকিয়ে আবার কক কক শব্দ করে ডাকল। নিকি পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি মোটেও দেরি করতে চাইনি। ক্রিনিটি আমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছে।
পাখিটির গায়ের রং কুচকুচে কালো, চোখ দুটি লাল, সে ডানা ঝাঁপটিয়ে আবার কক কক শব্দ করল। নিকি বলল, উঁহু। ক্রিনিটি মোটেও দুই নয়। ক্রিনিটি হচ্ছে রোবট! রোবটেরা অন্যরকম হয়।
কিকি নিকির কথা বুঝে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে আবার শব্দ করে আকাশে উড়ে গেল, নিকি তখন তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। এটি তাদের একরকম খেলা, প্রতিদিনই সে কিকির পেছনে পেছনে ছুটে যায়, সারাদিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। দিনের শেষে কিকি তাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
কিকির পেছনে পেছনে ছুটে ছুটে নিকি বনের ভেতর একটি হৃদের তীরে এসে দাঁড়াল। সেখানে অনেকগুলো বুনো পশু পানি খাচ্ছে, নিকিকে একনজর। দেখে তারা আবার পানি খেতে থাকে।
একটি বড় ঝাপড়া গাছের ডালে হঠাৎ একটি হুঁটোপুটি শোনা যায় সেদিকে না তাকিয়েই নিকি বুঝতে পারে এটি মিকু, ছোট একটি বানরের বাচ্চা, তার সাথে খেলতে এসেছে। নিকি ইচ্ছে করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল, আর মিক্কু গাছের উপর থেকে তার উপর লাফিয়ে পড়ল, তাল সামলাতে না। পেরে নিকি নিচে পড়ে যায়, মিক্কু তখন তার শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে। নিকি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে হি হি করে হাসতে থাকে আর মিক্কু তখন নিকিকে ঘিরে লাফাতে থাকে। নিকি মিক্কুর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, মিকু, তোমার বুদ্ধিমত্তা আছে?
মিক্কু কিচিমিচি শব্দ করে একটি লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে উঠে বসে তারপর সেখান থেকে নেমে তার কাপড়টা টানতে থাকে। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। এই কাপড়টা খোলা যাবে না। আমার মা বলেছে আমাকে সবসময় কাপড় পরে থাকতে হবে।
মিকু কথাটা বোঝার মতো ভঙ্গি করল, নিকি তখন মিক্কুকে কাছে টেনে এনে বলল, তুমি বানর। আমি মানুষ। বানরের বুদ্ধিমত্তা নেই। মানুষের আছে। বুদ্ধিবৃত্তি কী জান?
মিকু মাথা নাড়ল। নিকি বলল, আমিও জানি না। ক্রিনিটি আমাকে বলেছে আমি বুঝিনি। তুমিও বুঝবে না। বোঝার দরকার নেই। চল আমরা খেলি।
মিকু কথাটা বুঝতে পেরে ছুটতে শুরু করে, তার পিছু পিছু নিকি। ছুটতে ছুটতে তারা বালুবেলায় আছড়ে পড়ে, গড়াগড়ি খেতে থাকে। তাদের মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো পাখি উড়তে থাকে, কিচিমিচি শব্দ করে তারা নিকির আশপাশে নেমে এসে খেলায় যোগ দেয়। নিকি হাত বাড়িয়ে পাখিগুলো ধরার চেষ্টা করে—একটি-দুটি ধরা দেয় অন্যগুলো সরে গিয়ে আবার তার কাছে ছুটে আসে।
বেলা গড়িয়ে এলে নিকি নরম বালুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে পরম শান্তিতে বালুতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাছাকাছি একটি গাছে বসে কিকি তার দিকে নজর রাখে, একটু দূরে একটি গাছে মিক্কু পা দুলিয়ে বসে থাকে।