একজন মানুষ।
মানুষ? নির্কি ও ত্রিপি দুজনে একসাথে চমকে চিৎকার করে ওঠে।
হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে একজন মানুষ।
কী বলছে মানুষটি?
তোমরা এক্ষুণি নিজেরাই সেটা শুনতে পাবে।
নিকি দুই হাত উপরে তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি এতো বড় একটা খবর আমাকে এতো পরে দিচ্ছ?
পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে আমি খবরটি তোমাদের দিতে চাচ্ছিলাম না। যদি এটি কোনো একটি রোবটের ষড়যন্ত্র হয়?
রোবটের ষড়যন্ত্র? নিকি অবাক হয়ে বলল, রোবটের ষড়যন্ত্র?
হ্যাঁ। সে জন্যে আমাকে নিশ্চিত হতে হয়েছে যে এটি কোনো রোবট নয়।
তুমি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছ? কী বলেছে মানুষটা?
ক্রিনিটি উত্তর দেবার আগেই ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, মানুষটা কতো বড়? কী বলেছে মানুষটা?
ছেলে না মেয়ে? কোথায় থাকে?
নিকি এবং ত্রিপির আরো প্রশ্ন ছিল কিন্তু ঠিক তখন হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা এক মুহূর্তের জন্যে অন্ধকার হয়ে আবার আলোকিত হয়ে ওঠে এবং কিছু বোঝার আগেই তারা দেখতে পেল ঠিক তাদের সামনে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি কিন্তু সেটি এতো জীবন্ত যে নিকি এবং ত্রিপির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
মানুষটির সোনালি চুল এবং নীল চোখ। নিকি আর ত্রিপি আগে সত্যিকারের মানুষ দেখে নি, তারপরও তারা বুঝতে পারল মানুষটি খুব সুদর্শন। মানুষটি চারদিক একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তারপর ভরাট গলায় বলল, আমার নাম। ফ্লিকাস। আমি একজন মানুষ আমার বয়স চৌত্রিশ। ভয়ঙ্কর ভাইরাস আক্রমণে। পৃথিবীর সব মানুষ মারা গিয়েছে কিন্তু প্রকৃতির কোনো এক বিচিত্র খেয়ালে আমি মারা যাই নি। আমি বেঁচে গিয়েছি, যেহেতু আমি বেঁচে গিয়েছি আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত আমার মতো আরও কিছু মানুষ বেঁচে গিয়েছে। তাদের সংখ্যা হয়তো খুবই কম, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই আছে।
মানুষটি একটি নিঃশ্বাস নেয় এবং হঠাৎ করে তার মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে। সে নীচু গলায় বলে, আমি ভেবেছিলাম যারা বেঁচে আছে তারা নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বের করবে, আমি সেজন্যে অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে এলো না। তখন আমার মনে হলো তাহলে সত্যিই কী সারা পৃথিবীতে শুধু আমি একা বেঁচে আছি? আর কেউ বেঁচে নেই? কেউ বেঁচে নেই?
তখন আমি ঠিক করেছি যে আমি নিজেই সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে খুঁজব। খুঁজে দেখব আর কোথাও বেঁচে থাকা মানুষকে খুঁজে পাই কি-না। আমি প্রযুক্তির মানুষ নই। নিবিড় একটি গ্রামের একটি কফি হাউজে আমি গান গাইতাম, প্রযুক্তির কিছু আমি জানি না। তারপরেও আমি একটু একটু করে শিখেছি, পৃথিবীর পরিত্যক্ত নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেছি এবং সারা পৃথিবীতে এই তথ্যটি ব্রডকাস্ট করছি।
যদি কোনো মানুষ এই মুহূর্তে আমার কথাগুলো শুনছে আমি তাকে শুভেচ্ছা জানাই, ভালোবাসা জানাই। ফ্লিকাস হাসি মুখে বলল, আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই যে পৃথিবীতে আমরা পুরোপুরি একা নই, নিঃসঙ্গ নই। তোমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক আমার সাথে যোগাযোগ করো। আমরা সবাই মিলে আবার নতুন পৃথিবীর জন্ম দেব। মানুষের কলকাকলীতে এই পৃথিবী আবার মুখরিত হয়ে উঠবে।
হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে মানুষের ছবিটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিকি আর ত্রিপি লাফিয়ে উঠে আনন্দে চিৎকার করে ক্রিনিটিকে জড়িয়ে ধরে লাফাতে থাকে। ক্রিনিটি তাদের প্রাথমিক উচ্ছসিটি একটু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, আশা করছি ফ্লিকাস সত্যিকারের মানুষ, এটি কোনো কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি নয়।
নিকি বলল, কী বলছ ক্রিনিটিঃ ফ্লিকাস কেন কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি হবে? তুমি দেখছ না সে আমাদের মতো মানুষ? কী সুন্দর করে হাসতে পারে তুমি দেখ নি?
ক্রিনিটি বলল, আমি সত্যিকার বা কৃত্রিম কোনো হাসিই বুঝতে পারি না, তাই আমি ফ্লিকাসের বক্তব্যটি টুরিন টেস্ট করেছি।
সেটি কী?
কোনো বক্তব্য সত্যিকারের মানুষের না কৃত্রিম রোবটের সেটি বোঝার একটি পরীক্ষা।
তুমি পরীক্ষা করে কী দেখেছ?
আমি দেখেছি যে ফ্লিকাস সত্যিকারের মানুষ। কিংবা—
কিংবা কী?
মানুষ থেকেও বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী।
ত্রিপি হেসে বলল, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান হতে পারে শুধু একটি মাত্র প্রাণী।
সেটি কী?
সেটি হচ্ছে আরেকজন মানুষ! বলে ত্রিপি হি হি করে হাসতে থাকে।
নিকি বুক থেকে আটকে থাকা একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, ক্রিনিটি, আমরা কখন ফ্লিকাসের কাছে যাব?
তার সাথে আগে যোগাযোগ করে নিই। তারপর রওনা দেব।
সে কতদূর থাকে ক্রিনিটি?
বেশ অনেক দূর। আমাদের ভালো একটা বাইভার্বাল দরকার তা না হলে যেতে অনেকদিন লাগবে।
তুমি তাহলে আরেকটা বাইভার্বাল ঠিক কর ক্রিনিটি।
করব।
ঠিক করলেই আমরা যাব।
ঠিক আছে।
নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা যখন যাব তখন আমাদের মতো পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে হয়তো আরো অনেক বাচ্চা চলে আসবে।
হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আসবে। রোবটেরা যদি আটকে না রাখে তাহলে নিশ্চয়ই চলে আসবে।
নিকি ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার কী মনে হয় ত্রিপি, রোবটেরা কী সত্যিই আরো বাচ্চাদের আটকে রেখেছে?
রাখতেও তো পারে। আমাকে যেরকম রেখেছিল।
তাহলে তো অনেক ঝামেলা হবে। তাই না ত্রিপি?
হলে হবে। ফ্লিকাস সব ঝামেলা দূর করে দেবে।
নিকি মাথা দুলিয়ে হাসল, বলল, ঠিকই বলেছ। ফ্লিকাস সব ঝামেলা দূর করে দেবে।