ত্রিপি মাদুলিটি ভালো করে দেখে বলল, এটি কী সুন্দর। আমি কখনো এটি গলা থেকে খুলব না।
আর নিকি, তুমি মনে রেখো ত্রিপি এখানে নতুন এসেছে। এখানকার সবকিছু তার অপরিচিত। তাকে তুমি দেখে শুনে রাখবে। তাকে কোনো অপরিচিত পরিবেশে ঠেলে দেবে না।
ঠিক আছে ক্রিনিটি।
তাকে নিয়ে কোনোরকম বিপজ্জনক কাজ করবে না।
করব না।
কোনোরকম ঝুঁকি নেবে না।
নেব না ক্রিনিটি।
তাহলে যাও, আর অন্ধকার হবার আগে ফিরে এস।
নিকি বলল, ফিরে আসব। তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না।
বনের ভেতর ঢোকার সাথে সাথেই একটি গাছের ডালে হঠাৎ করে প্রচণ্ড হুঁটোপুটি শুরু হয়ে গেল। ত্রিপি ভয় পেয়ে নিকিকে আঁকড়ে ধরে বলল, ওটা কী?
নিকি হেসে বলল, মিক্কু! আমার বন্ধু।
নিকির সাথে ত্রিপিকে দেখে মিক্কু বিশেষ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, সে কাছে এসে গাছের ডালে বসে সেটি আঁকাতে লাগল। নিকি বলল, মিক্কু, তোমার কোনো ভয় নেই। এটি হচ্ছে ত্রিপি। ত্রিপি আমার মতো একজন মানুষ। আমার বন্ধু।
মিক্কু ডাল আঁকানো বন্ধ করে এবারে একটু কাছে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে ত্রিপিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। নিকি হাত বাড়িয়ে বলল, এসো। আমার কাছে এসো।
মিক্কু এবারে লাফ দিয়ে গাছের ডাল থেকে নিকির ঘাড়ে এসে বসে। ত্রিপি অবাক হয়ে বলল, তুমি বানরে সাথে কথা বলতে পার?
নিকি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, একটু একটু পারি।
কেমন করে পার?
আমি জানি না। অনেক ছোট থাকতে আমি তো এদের সাথে সাথে বড় হয়েছি, তাই আমি ওদের বুঝতে পারি ওরাও আমাকে বুঝতে পারে।
কী আশ্চর্য!
মোটেও আশ্চর্য না। তুমি পারবে।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। পারব না। পারবে।
চেষ্টা করলেই পারবে।
ত্রিপি নিকির ঘাড়ে বসে থাকা মিকূকে দেখল, তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, আমার কাছে এসো মিকু।
মিকু মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটি শব্দ করল। নিকি মাথা নেড়ে বলল, না মি, নিকি মোটেও তোমাকে মারবে না! ত্রিপি তোমাকে আদর করবে। যাও, ত্রিপির কাছে যাও।
মিক্কু আরো একবার আপত্তি করল। নিকি তখন মুখ কঠিন করে বলল, যাও বলছি, না হলে আমি তোমার সাথে খেলব না।
মিক্কু এবারে খুব অনিচ্ছার সাথে এবং খুব সতর্কভাবে ত্রিপির কাছে গেল। ত্রিপির ঘাড়ে বসে সে তার চুলগুলো একবার শুকে দেখল। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি নাড়াচাড়া করল তারপর একটু কামড় দিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর তার কানটা ধরে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করল, ত্রিপির শুড়শুড়ি লাগছিল, সে হি। হি করে হাসতে শুরু করে।
নিকি বলল, ব্রিপি, তোমার কোনো ভয় নেই। মিক্কু সবাইকে এভাবে পরীক্ষা করে দেখে।
আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না, আমার শুড়শুড়ি লাগছে। সে হাত বাড়িয়ে মিক্কুকে ঘাড় থেকে নামিয়ে কোলে নেয় তারপর আদর করে বুকে চিপে ধরে, মিক্কু আদরটা উপভোগ করে তার মাথাটা ত্রিপির বুকে লাগিয়ে রাখল।
নিকি বলল, এই দেখো! মিক্কুর সাথে তোমার ভাব হয়ে গেছে।
ত্রিপি মিকুর মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি সবসময় ভাবতাম বনের পশুপাখি অনেক হিংস্র হয়।
নিকি বলল, তুমি যদি হিংস্র হও তাহলে তারাও হিংস্র হবে।
আমি মোটেও হিংস্র হব না।
মিক্কুকে কোলে নিয়ে দুজনে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কাছাকাছি একটি গাছের উপর থেকে হুঁটোপুটির একটা শব্দ শোনা গেল, মিক্কু উত্তেজিতভাবে মুখ তুলে তাকায় তারপর বিচিত্র ভঙ্গিতে চিৎকার করতে করতে ত্রিপির কোল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে গাছের উপর উঠে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়!
ত্রিপি অবাক হয়ে বলল, কী হল? কী হল ওর?
নিকি হি হি করে হেসে বলল, ওদের একদল আরেকদলের গাছ দখল করবে। সে জন্যে সবাই মিলে মারামারি করতে যাচ্ছে।
মারামারি? এই ছোট বানরের বাচ্চা মারামারি করবে?
ওটা ওদের একধরনের খেলা।
কী বিচিত্র খেলা!
হ্যাঁ। নিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খুবই বিচিত্র। কিন্তু খুবই সোজা।
নিকি ত্রিপিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হ্রদের তীরে বালুবেলায় হাজির হয়। সামনে নীল হ্রদের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে। খোল আকাশ সেখানে সাদা মেঘ। ত্রিপি সেদিকে তাকিয়ে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে বলল, কী সুন্দর!
নিকি কিছু বলল না। ত্রিপি বলল, নিকি! তোমার কাছে এটা সুন্দর লাগছে না?
নিকি মাথা নাড়ল, লাগছে আসলে আমি তো সবসময় এটা দেখি তাই। এখন আলাদা করে চোখে পড়ে না।
আমি তো বেশিরভাগ সময় থাকতাম একটা ঘরের ভেতর। আমার চারপাশে ছিল ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর রোবট আর যন্ত্রপাতি। শুধু বিকেলবেলা আমি কিছুক্ষণের জন্যে বের হতাম। সারাদিন অপেক্ষা করতাম কখন বিকেল হবে!
নিকি বলল, এখন তোমার আর অপেক্ষা করতে হবে না। তোমার ইচ্ছে করলে দিন-রাত বাইরে থাকতে পারবে। তোমার ঘরের ভেতরেই ঢুকতে হবে না।
হ্যাঁ। কী মজা!
ঠিক তখন গাছের উপর দিয়ে একটা কালো পাখি ক ক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে এল। নিকি উপরে তাকায়, তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, হাত নেড়ে বলে, কিকি!
পাখিটা তার মাথার উপর দিয়ে উড়তে থাকে, নীচে নেমে আসে না। নিকি ডাকল, এসো কিকি। এসো।
কিকি উড়তে উড়তে ডাকল, কঁ কঁ।
নিকি বলল, তোমার কোনো ভয় নেই। এ হচ্ছে ত্রিপি। ত্রিপি আমার বন্ধু।
কিকি আবার ডাকল, কঁ। কঁ।
নিকি বলল, এসো কিকি। এসো।
কালো পাখিটা তখন উড়ে এসে নিকির হাতে বসল। গায়ের রং কুচকুচে কালো, লাল চোখ। ঠোঁটগুলো শক্ত এবং ধারালো। ত্রিপি একধরনের বিস্ময়। নিয়ে পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিস করে বলে, আমি কখনো এতো কাছ থেকে কোনো পাখি দেখি নি!