নিকি নীচে নেমে এসে ত্রিপির হাত ধরে বলল, চল যাই।
ত্রিপি বলল, চল।
দুজন ছুটতে ছুটতে হ্রদের তীরে হাজির হয়। ছোটাছুটি করা ত্রিপির অভ্যেস নেই, সে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, নিচে নেমে বলল, এখন কী করব?
এই হ্রদে ড়ুব দিতে হবে।হদের নিচে একটি গর্ত আছে সেটি দিয়ে বের হতে হবে।
আমি–আমি পারব না।
পারবে। তোমার কিছুই করতে হবে না—আমি তোমাকে নিয়ে যাব। নিকি তার ব্যাগ থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট স্বচ্ছ গোলক বের করে ত্রিপির হাতে দিয়ে বলল, এগুলো তোমার মুখে রাখ। যখনই নিঃশ্বাস নিতে হবে দাঁত দিয়ে একটি ভেঙে নেবে। সাথে সাথে নিঃশ্বাস নেবার বাতাস পেয়ে যাবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। শুধু নিঃশ্বাস নেবার সময় হাত দিয়ে নাকটা বন্ধ করে রাখবে।
ঠিক আছে।
হ্রদের পানিটা মনে হবে খুব ঠাণ্ডা কিন্তু দেখবে একটু পরেই অভ্যাস হয়ে যাবে।
ঠিক আছে।
গর্তটি একটু ছোট, কষ্ট করে বের হতে হবে। তুমি ভয় পেয়ো না আমি তোমাকে ঠেলে বের করে দেব।
ঠিক আছে।
হ্রদের নীচে দেয়ালের ছোট গর্তের ভেতর থেকে বের হওয়া নিয়ে নিকির একটু দুশ্চিন্তা ছিল, কিন্তু দেখা গেল দুজনে সহজেই বের হয়ে এলো। দুজন যখন পানির উপরে বের হয়ে এল ঠিক তখন শক্ত হাতে কেউ তাদের ধরে ফেলে, কিন্তু বোঝার আগেই তাদেরকে একটি বাইভার্বালে তুলে ফেলে এবং মৃদু গর্জন করে বাইভার্বালটা উড়ে যেতে শুরু করে।
ত্রিপি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, বলল, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমাকে।
ত্রিপি শুনতে পেল রোবটটি তার ধাতব কণ্ঠস্বরে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই মেয়ে, আমি ক্রিনিটি।
০৯. সাবধানে থেকো
ক্রিনিটি বলল, তোমরা দুজন সাবধানে থেকো। আমি বাইভার্বালটিকে দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে সরে যাব।
নিকি জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমরা তাড়াতাড়ি সরে যেতে চাই। যখন তারা বুঝতে পারবে তুমি এই মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসেছ তখন তারা আমাদের খুঁজতে বের হবে।
আমার মনে হয় খুঁজতে বের হবে না।
কেন?
নিকি ইতস্তত করে বলল, মনে আছে তুমি যখন জীবনরক্ষাকারী ব্যাগটি আমাকে দেখাচ্ছিলে তখন–
তখন কী?।
তখন তুমি আমাকে একটি বিস্ফোরক দেখিয়েছিলে? যেটি আমার ছোঁয়াও নিষেধ?
হ্যাঁ। সেই বিস্ফোরকটার কী হয়েছে?
আমি সেটি ছুঁয়েছি। টাইমারটা সেট করে ত্রিপির ঘরে রেখে এসেছি।
ক্রিনিটি বলল, টাইমারটা কতোক্ষণের জন্যে সেট করেছ?
পনেরো মিনিট। আমার মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে এটি বিস্ফোরিত হবে।
নিকির কথা শেষ হবার আগেই একটি আলোর ঝলকানি মুহূর্তের জন্যে চারদিক আলোকিত করে দেয়, প্রায় সাথে সাথেই দূর থেকে একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। নিকি শিষ দেবার মতো শব্দ করে বলল, দেখেছ? জাতীয় গবেষণাগারের অর্ধেকটা উড়ে গেছে!
ক্রিনিটি বলল, হ্যাঁ। সাত বছরের একটি মানবশিশু এটি ঘটিয়েছে সেটি মনে হয় সাধারণের কাছে কখনো বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
ত্রিপি বলল, নিকির বয়স সাত হলেও তার কাজকর্ম বড় মানুষের মতো।
নিকি বিড় বিড় করে বলল, আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট মানুষ থাকতে চাই।
ক্রিনিটি সারারাত বাইভার্বালটি চালিয়ে নিয়ে গেল, ভোর রাতে সেটিকে একটি শহরতলীতে থামায়। পুরো শহরতলীটি পরিত্যক্ত, বাড়িঘর বিবর্ণ, গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে। তার মাঝামাঝি খানিকটা ফাঁকা জায়গার মাঝে সে বাইভার্বালটি নামিয়ে আনে। তারা দিনটা বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার রওনা দেবে।
ক্রিনিটি কিছু গাছের আড়ালে ঘাসের ওপর বিছানা তৈরি করে তাদের খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার কথা বলল কিন্তু নিকি আর ত্রিপি দুজনেই আবিষ্কার করল তাদের চোখে ঘুম আসছে না। তখন দুজনেই বুনো গাছগাছালিতে ঢেকে যাওয়া এই শহরতলীটি দেখতে বের হলো। একসময় এখানে মানুষ থাকত ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করত এখন কেউ নেই, নির্জন গা ছমছমে একটি পরিবেশ, দেখে নিকি আর ত্রিপি দুজনেই বুকের ভেতর একধরনের হাহাকার অনুভব করে। হাঁটতে হাঁটতে ত্রিপি একটি ছোট বাসার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। নিকি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
এই রকম একটি বাসায় আমি থাকতাম।
তোমার মনে আছে?
একটু একটু মনে আছে।
তোমার বাবা-মায়ের কথা মনে আছে?
ত্রিপি কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করল, তারপর বলল, মাঝে মাঝে আমি একজন মহিলাকে স্বপ্নে দেখি, স্বপ্নে আমাকে আদর করে, মনে হয় সেই মহিলাটিই আমার মা।
তার কথা তোমার মনে নেই?
না। শুধু আবছাভাবে একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। আমি মায়ের হাঁটুর ওপর বসে আছি, মা তার চেয়ারে আস্তে আস্তে দুলছে আর গান গাইছে। এটি সত্যি না আমার কল্পনা আমি জানি না।
নিকি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না, দুইজন পাশাপাশি কিছুদূর হেটে যায়। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তোমার মায়ের কথা তো তুমি জাননো?
আমার জানার কথা না। কিন্তু আমি জানি।
কিভাবে জান?
ক্রিনিটির কাছে আমার মায়ের হলোগ্রাফিক ভিডিও আছে, সে মাঝে মাঝে আমাকে সেটি দেখতে দেয়। সেখানে আমার মা-কে আমি দেখেছি। আমার মা সেখানে যখন কথা বলে তখন মনে হয় সত্যি সত্যি আমার মা আমার সাথে কথা বলছে।
ত্রিপি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি তোমার সাথে কথা বলছি। একটি সত্যিকার মানুষ! তোমার হয় নিকি?
হয়। কেন জান?
কেন?
আমার মা মারা যাবার আগে ক্রিনিটিকে বলে গিয়েছিল যে মানুষেরা বেঁচে আছে সারা পৃথিবী খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বের করতে হবে। আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।