বাইনোকুলারে মানুষটিকে অনেক কাছে দেখায় কিন্তু সত্যিকার মানুষটি কথা শোনার জন্যে কাছে চলে আসে না, তারপরেও নিকির কেন যেন মনে হলো, মেয়েটি তার কথা শুনতে পেয়েছে এবং একধরনের আশা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিকি বাইনোকুলারটা নামিয়ে কিভাবে মেয়েটির কাছে যাবে সেটি নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করল, কিন্তু সে খুব ভালোভাবে কোনো পরিকল্পনা করতে পারল না। তাই সে সবসময় যা করে এবারেও সেটিই করল, কোনো কিছু পরিকল্পনা না করেই সাবধানে বিল্ডিং-এর দিকে এগুতে থাকল। তাকে যদি কেউ দেখে ফেলে তখন কী হবে সেটি নিয়ে সে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করল না। খুব বড় ধরনের বিপদ হয়ে গেলে ক্রিনিটি এসে তাকে উদ্ধার করে ফেলবে এই ধরনের একটি ভাবনা সব সময় তার মাথায় খেলা করে।
মেয়েটাকে যেখানে দেখেছিল তার নীচে এসে দাঁড়িয়ে নিকি বিল্ডিংটি পরীক্ষা করে। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না তাই সে তা চোখে নাইট গগলসটা পরে নেয়। সাথে সাথে চারদিক প্রায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল কিন্তু তারপরেও দৃশ্যটি কেমন যেন অবাস্তব দেখায়। খালি চোখে যে সব জিনিষ অস্পষ্ট এই গগলসে সেগুলো অনেক সময় স্পষ্ট। নিকি কিছুক্ষণ চোখে গগলস পরে এদিক-সেদিক তাকায় এবং ধীরে ধীরে একটু অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
বিল্ডিংটিতে অনেক ধরনের কারুকাজ এবং সে কারণে নানাধরনের ছোট বড় খাঁজ। নিকি ইচ্ছে করলে চোখ বন্ধ করে এই খাজগুলো ধরে ধরে উপরে উঠে যেতে পারবে। মিক্কুর সাথে প্রতিযোগিতা করে সে কতোবার মোটা মোটা গাছের প্রায় মসৃণ কাণ্ড ধরে গাছের উপরে উঠে গেছে। নিকি তাই দেরি করল না, সুদৃশ্য বিল্ডিংটির দেয়াল ধরে প্রায় খামচে খামচে উপরে উঠে গেল। যে জানালাটির শিক ধরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল তার কার্নিশে দাঁড়িয়ে সে ভেতরে। উঁকি দেয়। ঘরের মাঝে একটি বিছানা সেই বিছানায় মেয়েটি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটি ঘুমিয়ে নেই, কারণ মাঝে মাঝেই মেয়েটির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিকি বুঝতে পারল মেয়েটি আসলে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
নিকি কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে সে জানালার কাছে টোকা দেয়। মেয়েটি শুনতে পেল বলে মনে হলো না তখন নিকি দ্বিতীয়বার টোকা দিলো, আগের থেকে একটু জোরে। এবারে মেয়েটি শুনতে পেয়ে উঠে বসে এদিক-সেদিক তাকাল। নিকি তখন আবার জানালায় টোকা দিলো। এবার মেয়েটি জানালার দিকে তাকাল এবং নিকিকে দেখতে পেল এবং মনে হলো সে বুঝি সাথে সাথে পাথরের মতো জমে গেছে। তার নিচের ঠোঁট দুটি কয়েকবার নড়ে ওঠে কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয় না।
নিকি চোখ থেকে তার বিদঘুটে গগলসটা খুলে নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, কেউ তার কথা শুনে ফেলতে পারে তাই সে মুখে কোনো শব্দ করল না। মেয়েটির কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে নিকি সত্যি সত্যি জানালার বাইরে কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে, যখন শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারল তখন সে প্রায় ছুটে জানালার কাছে এসে হাজির হয় জানালার শিকগুলোর ভেতর থেকে হাত বের করে তাকে ধরার চেষ্টা করে। উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে বলল, তুমি? তুমি কিভাবে এখানে এসেছ? তুমি পড়ে যাবে এখান থেকে। সর্বনাশ!
নিকি বলল, আমি পড়ব না।
মেয়েটি বলল, কেমন করে উঠেছ এখানে?
দেয়াল বেয়ে বেয়ে।
দেয়াল বেয়ে বেয়ে কেমন করে উঠেছ? এটি হতে পারে না।
পারে। আমি পারি।
মেয়েটি কিছুক্ষন বিস্ফোরিত চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ফিস্ফিস করে বলল, তুমি কেন এসেছ?
আমি ভেবেছিলাম তুমি হ্রদের পারে যাবে। আমি তোমার জন্যে করছিলাম।
আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে বের হতে দেয় নি। আমাকে ঘরে আটকে রেখেছে।
ঘরে আটকে রেখেছে?
হ্যাঁ।
কেন?
মেয়েটি নিচের দিকে তাকিয়ে একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার কথা বলিনি সেজন্যে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, আমার কথা?
হ্যাঁ।
আমার কী কথা?
প্রত্যেকদিন ওরা আমার সাথে কথা বলে। সারাদিন কী হয়েছে জানতে চয়ি। কালকে আমার সাথে যখন কথা বলেছে তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমি কী করেছি। তোমার সাথে দেখা হয়েছে আমি সেটি বলতে চাইনি-আমি চুপ থেকেছি।
তারপর।
তখন তারা সন্দেহ করেছে। আরো বেশি করে জানতে চেয়েছে। আমি তখন রেগে গিয়ে বলেছি আমি বলব না। তখন তারাও রেগে গিয়েছে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, রেগে গিয়েছে? ক্রিনিটি কখনো রেগে যায় না। রোবটরা রাগতে পারেনা।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, পারে। আমি যাদের কথা বলছি তারা রেগে যেতে পারে। তারা যখন রেগে যায় তখন তারা আমাকে–আমাকে–মেয়েটি কথা বন্ধ করে হঠাৎ থেমে গেল।
তোমাকে কী?
মেয়েটি মাথা নিচু করে বলল, আমি সেটি বলতে চাই না।
নিকি জিজ্ঞেস করতে চাইল, কেন তুমি বলতে চাও না? কিন্তু কী ভেবে সে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি আমার সাথে যাবে?
আমি?
হ্যাঁ।
কেমন করে?
তুমি বল যাবে কী না—তাহলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
মেয়েটি জানালার বাইরে কার্নিশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট এই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল, তার সাথে এই ছেলেটির খুব বড় একটি পার্থক্য রয়েছে। সে কেমন যেন দুর্বল, তার মাঝে ভয়, অনিশ্চয়তা, সে একটি ছেলেমানুষের মতো, আর এই ছেলেটার মাঝে কী আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস, কোনোকিছুতেই তার ভয় নেই, যেন সে একটা বড় মানুষ। মেয়েটি আস্তে আস্তে বলল, হ্যাঁ, যেতে তো চাই। কিন্তু–