আমি এই জায়গাটা চিনি না।
কয়েকদিন থাকলেই তুমি চিনে নেবে।
এখানে রোবটরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করবে। আমার সেটি ভালো লাগে না।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, সেটি মোটেও খারাপ না। রোবটেরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করে, আমি জানি। মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে ভুল কথা বলে দিই তখন তাদের কপোট্রন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। খুব মজা হয়। তখন।
নিকি চারদিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এটির চারদিকে দেয়াল। আমি দেয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গায় থাকতে পারব না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।
নিকির কথা শুনে মনে হলো মেয়েটি একটু অবাক হল। বলল, কেন, নিঃশ্বাস কেন বন্ধ হবে? দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে জায়গাটা খুব নিরাপদ। বন্য পশু আসতে পারে না। কপোট্রন বিগড়ে গেছে এরকম রোবটও আসতে পারে না।
নিকি বলল, সেটি আমি জানি না। কিন্তু খোলা জায়গায় থাকলে অনেক মজা। যেখানে খুশি যাওয়া যায়। যা খুশি করা যায়।
যদি কোনো বিপদ হয়?
হলে হবে।
মেয়েটি কেমন যেন বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে গেল। বলল, কিন্তু এখানে থাকলে কোনো বিপদ নেই। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমাকে খেতে দেবে। তোমাকে বই পড়তে দেবে। আনন্দ করতে দেবে। যদি তোমার অসুখ হয় তাহলে চিকিৎসা করবে।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, কিন্তু এর মাঝে কোনো আনন্দ নেই।
তাহলে তুমি কী করতে চাও?।
তুমি আমার সাথে চল, আমরা দুজন মিলে থাকব। আমি যেখানে থাকি সেটি খুব সুন্দর জায়গা। খুব ভালো জায়গা। সেখানে কিকি আছে, মিক্কু আছে আরো অনেকে আছে। আমরা তাদের সঙ্গে খেলব। আনন্দ করব।
কিকি কে? মিক্কু কে?
কিকি হচ্ছে পাখি। আর মিক্কু বানর।
তুমি বনের পশুপাখির সাথে খেল? তারা তোমাকে আক্রমণ করে না?
নিকি খুক করে হেসে ফেলল, বলল, কেন, বনের পশু আমাকে আক্রমণ করবে? বনের পশুরা আমার বন্ধু। তারা কখনো আমাকে আক্রমণ করে না।
মেয়েটি খুব অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। ইতস্ততঃ করে। বলল, বন্ধু, বনের পশুরা তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ।
তাহলে আমাকে যে সবাই বলেছে বাইরের পৃথিবীতে আমার নিরাপদে থাকার কোনো উপায় নেই?
মিথ্যে কথা।
ঠিক এরকম সময় দূর থেকে ঘণ্টা বাজার মতো একটি শব্দ হলো। মেয়েটি তখন বলল, ঐ যে ঘণ্টা বাজছে।
কিসের ঘণ্টা?
আমার ফিরে যাবার ঘণ্টা। এখন আমার ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর বিকেলের নাস্তা খেয়ে লেখাপড়া করতে হবে।
নিকি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ও।
তুমি কী আমার সাথে যাবে? আমার মনে হয় তোমাকে পেলে রোবটরা খুশি হবে।
নিকি মাথা নাড়ল। বলল, না, আমি যাব না।
তাহলে আমি যাই। আমার যেতে দেরি হলে–মেয়েটি থেমে গেল।
তোমার যেতে দেরি হলে কী হবে?
মেয়েটির মুখটি কেমন যেন ম্লান হয়ে যায়, সেখানে কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ে। সে মাথা নেড়ে বলল, না। কিছু না।
মেয়েটি বলল, আমি এখন যাই?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, যাও।
মেয়েটি যখন মাথা নীচু করে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল তখন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিকির মনে হলো এই মেয়েটি আসলে খুব দুঃখি একটি মেয়ে। কেন মেয়েটা দুঃখি সেটি সে বুঝতে পারল না কিন্তু অকারণে তার মনটাও কেমন জানি দুঃখ দুঃখ হয়ে গেল।
নিকি অন্যমনস্কভাবে হ্রদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে—তখন হঠাৎ তার মনে হলো মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।
০৮. ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি তোমাকে কী জিজ্ঞেস করেছে?
আমি তাকে বিয়ে করব কী না।
তুমি কী বলেছ?
আমি রাজি হয়েছি।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে। সে চাপটি কমে। যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তুমি মেয়েটির নাম জান না, কিন্তু তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ?
সারা পৃথিবীতে যদি শুধু আমরা দুজন থাকি তাহলে আমাদের দুজনকে বিয়ে করতে হবে না?
সম্ভবত তোমার কথা সত্যি।
তাহলে তুমি আমার কথা শুনে এতো অবাক হচ্ছ কেন?
আমি মোটেও অবাক হচ্ছি না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট, আমার অবাক হবার ক্ষমতা নেই। আমি শুধু নিশ্চিতভাবে তোমাদের ভেতরে কী কথাবার্তা হয়েছে সেটি জানতে চেয়েছি।
আমি সেটি তোমাকে বলেছি।
হ্যাঁ বলেছ।
নিকি গম্ভীরমুখে বলল, তাহলে কি তুমি এখন আমাকে বলবে বিয়ে মানে কী?
পৃথিবীতে যখন মানুষেরা বেঁচে ছিল তখন একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা একসাথে থাকার পরিকল্পনা করত। তাদের দুজনের একসাথে থাকার শুরু করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটার নাম বিয়ে।
নিকি বিষয়টা ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল না, তারপরেও সে এটি বুঝে ফেলার ভান করে বলল, তাহলে আমার মা কী বিয়ে করেছিল?
হ্যাঁ করেছিল। তোমার বাবার সাথে তোমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে তোমার বাবা তোমার মা-কে ছেড়ে চলে যায়। তোমার মা তখন উষ্ণ অঞ্চলের এই ছোট দ্বীপটিতে চলে যায়। গৃহস্থালি কাজে সাহায্যের জন্যে আমাকে নিয়ে আসে।
নিকি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না, বলল, আমার বাবা কেন আমার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল? এটি অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার।
ক্রিনিটি বলল, মানুষ অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রাণী, আমি সেটি ব্যাখ্যা। করতে পারব না। আমি কখনও তাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি না।
কিন্তু কেন আমার বাবা আমার মা-কে ছেড়ে চলে গেল?
আমি তোমাকে বলেছি সেটি ব্যাখ্যা করতে পারব না। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল, সেটি কিভাবে কাজ করে আমাদের মতো তৃতীয় মাত্রার রোবট সেটি অনুমান পর্যন্ত করতে পারি না। দুজন মানুষ যখন পাশাপাশি থাকে তখন। তাদের পরস্পরের পছন্দ অপছন্দ অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি পর্যায়ে চলে যায়। সেটি অত্যন্ত ভঙ্গুর, অত্যন্ত নাজুক অত্যন্ত সংবেদনশীল।