ক্রিনিটি শান্ত গলায় বলল, বুঝেছি। কিন্তু-
আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাই না ক্রিনিটি। তুমি যেভাবে পার তাদের খুঁজে বের করবে। আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। এই কথাটি তোমার মনে থাকবে?
ক্রিনিটি বলল, মনে থাকবে।
তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি সেটি করবে।
অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি ব্যাপার কিন্তু তবুও ক্রিনিটি তার শীতল ধাতব হাত দিয়ে দ্বিতীয়বার তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে তোমার বাচ্চাটিকে আমি অন্য বাচ্চার কাছে নিয়ে যাব।
তরুণী মাটি ক্ৰিনিটির হাত ধরে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ক্রিনিটি তার নিস্পলক চোখে তরুণীটির দিকে তাকিয়েছিল, সে বলল, তোমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় উত্তেজিত না হয়ে তোমার বিশ্রাম নেয়া দরকার।
তুমি ঠিকই বলেছ ক্রিনিটি, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমি এখন এখানেই শোবো। আমি জানি আমি আর কোনোদিন উঠতে পারবো না। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
কী সাহায্য?
তুমি কি আমার বাচ্চাটিকে আমার বুকের ওপর শুইয়ে দিতে পারবে? আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে আমার বাচ্চার মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই।
ক্রিনিটি জানে এই দুর্বল মেয়েটির বুকের ওপর এই দুরন্ত ছটফটে শিশুটিকে শুইয়ে দিলে মেয়েটির অনেক কষ্ট হবে, কোনোভাবেই এই কাজটি করা উচিৎ হবে না। ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি প্রবল বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল কিন্তু সে চাপটিকে উপেক্ষা করে এই অযৌক্তিক কাজটি করল। শিশুটি দুই হাতে তুলে মেঝেতে শুয়ে থাকা তরুণীটির বুকে শুইয়ে দিলো।
শিশুটির দাঁতহীন মুখে মধুর একধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে তার ছোট হাত দুটি দিয়ে তার মায়ের রক্তমাখা ঠোঁট দুটি ধরে আনন্দে হাসতে থাকে। তরুণী মাটি তার দুই হাতে বাচ্চাটিকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, সোনা আমার। যাদু আমার। বেঁচে থাকিস বাবা। যেভাবে পারিস বেঁচে থাকিস।
সন্ধ্যে হওয়ার আগেই তরুণী মাটি মারা গেল। ছোট শিশুটি সেটি বুঝতে পারল না, সে তার মায়ের চুলগুলো ধরে খেলতেই থাকল।
ক্রিনিটি নিস্পলক দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার কপোট্রনে প্রবল একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করে।
০২. নিকি জানালাটি খুলে বাইরে তাকাল
নিকি জানালাটি খুলে বাইরে তাকাল। আকাশ নীল, কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। বাইরে রৌদ্রোজ্জ্বল একটি দিন। নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ কী মনে করে সে নিজেকে কোনোমতে টেনে জানালার ওপর উঠে বসে।
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, নিকি, তুমি ঠিক কী করতে চাইছ?
বাইরে যাব।
মানুষ জানালা দিয়ে বাইরে যায় না। মানুষ দরজা খুলে বাইরে যায়।
জানালা দিয়ে বাইরে গেলে কী হয়?
কিছু হয় না। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে যেতে হলে তোমাকে লাফিয়ে নামতে হবে। দরজা খুলে বের হতে হলে তুমি হেঁটে হেঁটে বের হতে পারবে।
নিকি তার দাঁতগুলো বের করে হাসল, বলল, কিন্তু আমি হেঁটে বের হতে চাই না। আমি লাফিয়ে বের হতে চাই। আমার লাফাতে খুব ভালো লাগে।
আমি সেটি লক্ষ করেছি। আজকাল বেশিরভাগ সময়ই তুমি লাফাতে পছন্দ করো।
আমি এখনো মিক্কুর মতো লাফাতে পারি না।
তুমি কখনোই মিরুর মতো লাফাতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর আর তুমি মানুষ।
নিকি একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও যদি বানর হতাম তাহলে খুব মজা হতো, তাই না ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি চাপ অনুভব করে। চাপটি কমিয়ে সে বলল, না। তুমি বানর হলে বেশি মজা হতো না।
নিকি মাথা নেড়ে বলল, হতো।
হতো না।
কেন হতো না?
কারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা বানরের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি। যার বুদ্ধিমত্তা যতো বেশি সেততো বেশি উপায়ে মজা করতে পারে।
নিকি মুখ সুচালো করে কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইলতারপর জিজ্ঞেস করল, বুদ্ধিমত্তা কী?
তোমার চারপাশে যা কিছু আছে সেটি দেখে বোঝার ক্ষমতা এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বা।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই।
কে বলেছে নেই?
আমি জানি।
কেমন করে জান?
এই যে তুমি কঠিন কঠিন জিনিম বলেছ আমি সেগুলো করতে পারিনা।
বুঝিনা।
তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে।
আমি বুঝতে চাইনা।
তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি মিষ্ণুর সাথে এক গাছ থেকে আরেকাছে লাফ দিতে চাই।
যাদের বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের শুধু এক গাছ থেকে আরেকাছে মাফ দিয়ে জীবন কাটাতে হয়না। তাদের আরো বড় কাজ করতে হয়।
নিকি কিছুক্ষন চিন্তা করল, তারপর বলন, জমির বুদ্ধিমত্তা ভালো লাগে।
না।
ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি ক্রিনিটির দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে ক্রিনিটি বলল, নিকি।
বল।
তুমি ঘরের বাইরে যাচ্ছ কিন্তু তোমার শরীরে কোনো কাপড় নেই।
আজকে অনেক সুন্দর রোদ। বাইরে ঠাণ্ডা নেই তাই আমার কাপড় পরারও কোনো দরকার নেই।
ক্রিনিটি কৃত্রিমভাবে তার গলার স্বরটি একটুখানি গভীর এবং থমথমে করে নিয়ে বলল, মানুষ শুধুমাত্র শীত থেকে বাঁচার জন্যে কাপড় পরে না। মানুষ হচ্ছে একটি সভ্য প্রাণী। মানুষকে সবসময় কাপড় পরতে হয়।