নিকি ভেসে ওঠার চেষ্টা করল না, সেখানে কী আছে সে জানে না, হঠাৎ করে এদিকে ভেসে উঠলে বিপদে পড়ে যেতে পারে। নিকি আবার পিছন দিকে ফিরে যেতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে ছোট গর্তটার মাঝে আটকে গিয়েছে, বের হতে পারছে না। হঠাৎ করে সে আতঙ্ক অনুভব করে, প্রাণপণে সে নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করল, কী করছে বুঝতে না পেরেই সে ছটফট করে সামনের দিকেই বের হয়ে এল। অল্প একটু বাতাসের জন্যে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, নিকি দুই পা দিয়ে দেয়ালটা ধাক্কা দিয়ে উপরে ভেসে উঠে, তারপর বুক ভরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নেয়।
নিকি এবার ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সে নিজেকে একটু শান্ত করল। দূরে জাতীয় গবেষণাগারের বিল্ডিংটি দেখা যাচ্ছে। ভেতরে বড় একটি খোলা জায়গা সেখানে ছোট বড় অনেকগুলো গাছ। নিকি চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কোথাও অস্ত্র হাতে কোনো রোবট পাড়িয়ে নেই। সে বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে দেওয়ালটা ধরে পানিতে ভেসে থাকে। তার এই মুহূর্তে বের হয়ে যাওয়া উচিৎ কিন্তু নিকি বের হল না, বিস্ময় নিয়ে সে এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর ভেসে ভেসে তীরে উঠে এল। পানি থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটেই সে খানিকদূর এগিয়ে যায়। একটি গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে সে জাতীয় গবেষণাগারের বিল্ডিংটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। ক্রিনিটির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এখানে ঠিক তার মতো একজন মানব শিশু আছে। সেই মানবশিশুটির সাথে কী তার দেখা হবে? যদি সত্যি দেখা হয় তাহলে দুজন কী নিয়ে কথা বলবে?
ঠিক এরকম সময় তার পেছন থেকে কে যেন খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
নিকি পাথরের মতো জমে গেল, প্রথমে মনে হলো সে এক ছুটে পানিতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিন্তু সে তা করল না। খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল, দেখল তার পেছনে কয়েক হাত দূরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে রোবট নয়, সে তার মতো মানুষ। তার থেকে একটু বড়, চুলগুলো লম্বা এবং কুচকুচে কালো। শরীরে হালকা সবুজ রঙের একটি কাপড়।
মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? গলার স্বরটি ভারী সুন্দর। শুনলে আরো শুনতে ইচ্ছে করে।
নিকি কাঁপা গলায় বলল, আমি নিকি।
নিকি?
হ্যাঁ।
তুমি কি রোবট?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি রোবট না।
তুমি তাহলে কী?
আমি মানবশিশু।
নিকি দেখল তার মতো দেখতে মানুষটির মুখে একধরনের হাসি ফুটে ওঠে, হাসি হাসি মুখে বলল, মিথ্যে কথা বল না। পৃথিবীতে কোনো মানুষ নেই। সব মানুষ মরে গেছে।
নিকি বলল, তাহলে তুমি কেমন করে বেঁচে আছ।
সেটি কেউ জানে না। আমি কিভাবে কিভাবে জানি বেঁচে গেছি।
তুমি যেরকম কিভাবে কিভাবে বেঁচে গেছ আমিও সেরকম কিভাবে কীভাবে বেঁচে গেছি।
ছোট মানুষটি জিজ্ঞেস করল, সত্যি?
সত্যি।
পৃথিবীতে শুধু সত্যিকারের মানুষেরা হাসতে পারে। তুমি কী হাসতে পার?
পারি।
হাস দেখি।
নিকি গম্ভীর মুখে বলল, এমনি এমনি কেউ হাসতে পারে না। হাসির কোনো কারণ ঘটলে মানুষ হাসতে পারে।
নিকি থেকে একটু বড় আর ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা কালো চুলের ছোট মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, তুমি এটি ঠিকই বলেছ। রোবটেরা যখন আমাকে নিয়ে গবেষণা করে তখন মাঝে মাঝে আমাকে বলে তুমি একটু হাস। আমি তাদেরকে বলি মানুষ ইচ্ছে করলেই হাসতে পারে না। তারা আমার কথা। বিশ্বাস করে না।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, রোবটদের কোনো কোনোদিক দিয়ে অনেক বুদ্ধি আবার কোনো কোনোদিক দিয়ে তারা অনেক বোকা।
মানুষটি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, তুমি সত্যি। সত্যি একজন মানুষ?
হ্যাঁ।
কী আশ্চর্য! তুমি একজন মানুষ আবার আমি একজন মানুষ। কিভাবে কিভাবে আমাদের দেখা হয়ে গেল। তাই না?
নিকি বলল, মোটেও কিভাবে কিভাবে আমাদের দেখা হয় নি। তোমাকে খুঁজে বের করতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, তোমরা আমাকে খুঁজে বের করেছ?
আমি আর ক্রিনিটি।
ক্রিনিটি কে?
ক্রিনিটি আমাকে দেখে শুনে রাখে। একটি রোবট—আমার বন্ধু। সে। আমাকে খুব ভালোবাসে।
ছোট মানুষটি না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, রোবট কাউকে ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসার জন্যে হরমোন দরকার হয়। রোবটদের। কোনো হরমোন নেই। শুধু মানুষের হরমোন আছে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমি পড়েছি। ছেলেদের একরকম হরমোন মেয়েদের অন্যরকম। ছোট মানুষটি এবারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিকিকে লক্ষ করল তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি ছেলে না মেয়ে?
আমি ছেলে। তুমি?
আমি মেয়ে। আমার বয়স এগারো। তোমার বয়স কতো?
নিকি বলল, আমার বয়স সাত।
এগারো বছরের মেয়েটি বলল, তুমি যখন বড় হবে তখন আমি আর তুমি বিয়ে করতে পারি। তখন আমাদের ছেলেমেয়ে হবে।
বিয়ে কেমন করে হয়?
সেটি আমি এখনো জানি না। আমি বিয়ে করার জন্যে একটি ছেলে পাব কখনো ভাবি নি তাই সেটি নিয়ে পড়াশোনা করি নি।
ও।
মেয়েটি কিছুক্ষণ নিকির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?
যদি পৃথিবীতে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ না থাকে তাহলে তো করতেই হবে।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, তাহলে অনেক মজা হবে। তুমি আর আমি এখানে থাকতে পারব।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমি এখানে থাকতে চাই না।
কেন?