আমি তাহলে কী করব?
তুমিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করো। আমরা রোবটেরা শুধুমাত্র যুক্তিপূর্ণ সমাধান বের করি। মানুষ মাঝে মাঝে অযৌক্তিক এবং অবাস্তব সমাধান বের করে ফেলে।
নিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।।
ক্রিনিটি সারাদিন নানাধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকল। নিকি প্রথমে কিছুক্ষণ তার পাশে থেকে সে কী করছে বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তখন সে বনের ভেতর ইতস্তত ঘুরতে শুরু করে। পৃথিবীর সব মানুষ মরে গিয়েছে কিন্তু অন্যসব প্রাণী, পোকামাকড়, পাখি, সরীসৃপ সবকিছু বেঁচে আছে। তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে নিকির খুব ভালো লাগে। সে অনেকক্ষণ একটি গুবরে পোকাকে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে দেখল। একটি ছোট মাকড়শাকে খুব ধৈর্য ধরে একটি জাল তৈরি করতে। দেখল। একটি প্রজাপতির পেছনে পেছনে সে অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াল। তারপর সে ধবধবে সাদা পুতুলের মতো একটি খরগোশের বাচ্চাকে দেখে তার সাথে ভাব করার চেষ্টা করল।
খরগোশের বাচ্চাটি সতর্ক দৃষ্টিতে নিকিকে লক্ষ করে, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে কিনা সেটি বুঝতে পারছিল না বলে একটু কাছাকাছি যেতেই ছোট ছোট কয়েকটি লাফ দিয়ে সেটি একটু দূরে সরে যাচ্ছিল। খরগোশটার পিছু পিছু নিকি অনেকদূর চলে এল, হঠাৎ করে আবিষ্কার করল সামনে টলটলে পানি। সে একটি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সামনে একটি হ্রদ হ্রদের উপর দিয়ে খাড়া দেওয়াল উপরে উঠে গেছে। ক্রিনিটি বলেছিল সে যেন খোলা জায়গায় না যায়, খরগোশের পিছু পিছু সে ঠিক খোলা জায়গায় চলে এসেছে।
নিকি কী করবে বুঝতে পারল না। ক্রিনিটি তাকে খোলা জায়গায় আসতে নিষেধ করেছে সত্যি কিন্তু আবার তাকে ভেতরে ঢোকার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাও করতে বলেছে। কাজেই বিল্ডিং ঘিরে তৈরি করা উঁচু দেওয়ালটার এতো কাছাকাছি যখন চলেই এসেছে তখন আরেকটু কাছে গিয়ে দেওয়ালটা ভালো করে দেখে আসা মনে হয় খুব অন্যায় হবে না।
নিকি তখন হ্রদের তীর ঘেষে দেওয়ালটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। দেওয়ালটার কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। সতর্কভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল তাকে কেউ দেখে ফেলেছে কিনা। কেউ তাকে দেখে নি, চারপাশে একধরনের সুনসান নীরবতা।
নিকি দেয়ালটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, শক্ত পাথরের উঁচু দেয়াল। উপরে ধাতব জাল দিয়ে ঘেরা, ক্রিনিটি বলেছে কেউ যেন সেদিক দিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে সেখানে উঁচু ভোল্টেজের বিদ্যুৎ রয়েছে। নিকি দেয়ালটা স্পর্শ করে হ্রদের দিকে এগিয়ে গেল। টলটলে হ্রদের পানিতে দেয়ালটা ড়ুবে। রয়েছে। নিকি সেদিক দিয়ে তাকিয়ে থাকে, মাঝখানে হ্রদের পানি যেখানে। গভীর সেখানে দেয়ালটাও কী অনেক গভীর থেকে শুরু হয়েছে?
নিকি কিছুক্ষণ দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে, দেয়ালের ওপর দিয়ে কেউ যেতে পারবে না, কিন্তু নীচে দিয়ে কী যাওয়া যাবে না? এমনকি হতে পারে হ্রদের পানির যেখানে দেয়ালটা উঠে এসেছে সেখানে বড় বড় গর্ত রয়েছে? কেউ ইচ্ছে করলে সেদিক দিয়ে ঢুকে যেতে পারবে? নিকি নিজে নিজে বিষয়টা চিন্তা করে, তারপর বড় মানুষের মতো গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল। ক্রিনিটিকে বলতে হবে কোনো একটি যন্ত্র দিয়ে হদের নিচে পরীক্ষা করে দেখতে। ক্রিনিটিকে সে কখনো পানিতে নামাতে পারে নি। রোবটের ধাতব দেহ নাকি পানিতে ভেসে থাকতে পারে না শুধু তাই না সার্কিটে পানি ঢুকে গেলে নাকি অনেক বড় সমস্যা হয় তাই কেউ পানির কাছে আসতে চায় না।
নিকি হ্রদের তীর ধরে একটি দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল। ইচ্ছে করলে সে নিজেই তো হ্রদের পানিতে ড়ুব দিয়ে নিচে নেমে দেখতে পারেন, ক্রিনিটির যন্ত্রপাতির জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে না। নিকি দুই এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর হলের পানিতে নেমে এলো।
হ্রদের কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে তার শরীরটি কাটা দিয়ে ওঠে, নিকি এক লাফে পানি থেকে উঠে আসতে চাইছিল কিন্তু সে উঠে এলো না। নিকি জানে পানিতে নামলে সবসময় প্রথমে শরীর কাটা দিয়ে ওঠে, একটু পর শরীর সেও ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। নিকি দাঁতে দাঁত চেপে আরো গভীর পানিতে নামতে থাকে। পায়ের নিচে শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল নুড়িপাথর। নিকি সাবধানে দেয়ালটা ধরে আরো গভীরে নেমে যায়। নিকি জানে ধীরে ধীরে শীতল পানিতে নামা থেকে এক ঝটকায় নেমে পড়া সহজ। তাই সে আর দেরি না। করে মাথা নিচু করে পানিতে ড়ুবে যায়। তীক্ষ্ণ কনকনে শীতে তার সারা শরীর শিউরে ওঠে। নিকি সেটা সহ্য করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পানির নিচে নেমে যেতে থাকে। দেয়ালটি স্পর্শ করে দেখে, শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল দেয়ালটি বৈচিত্র্যহীন। পানির নীচে সবকিছুকেই ঝাঁপসা দেখায়, মনে হয় দেয়ালটি হ্রদের গভীরে নেমে গেছে।
যতক্ষণ বুকের মাঝে বাতাস আটকে রাখতে পারল নিকি দেয়ালটি পরীক্ষা করে দেখল তারপর ভুস করে ভেসে উঠল। কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে তার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠছে। নিকি পানি থেকে উঠে পড়তে চাইল কিন্তু কী মনে করে আরো একবার সে পানিতে ড়ুব দেয়। দেয়ালটা স্পর্শ করে আরো গভীরে নেমে পড়ে। নিচে অন্ধকার ভালো করে কিছু দেখা যায় না-হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ সে একটি ফাঁকা জায়গা আবিষ্কার করে নিকির মনে হয় দেয়ালটার মাঝখানে একটি গর্ত। নিকি গর্তটা ভালো করে পরীক্ষা করতে পারল না তার আগেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিকি ভূঁস করে আবার। উপরে উঠে আসে। বড় করে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সে ড়ুব দিল, দ্রুত নিচে নেমে এসে সে গর্তটি পরীক্ষা করে, ছোট একটি গর্ত দেয়ালের অন্যপাশে চলে গেছে, নিকি ভেতর দিয়ে যেতে পারবে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে তার মাথাটা ঢোকালো, চওড়া দেয়ালের অন্যপাশে মাথাটা বের করে সে উপরে তাকায় পানির নীচে সবকিছু আবছা দেখায় তার মাঝে সে ফাঁকা একটা জায়গা দেখতে পেল। ইচ্ছে করলেই সে এখন দেয়ালে ঘেরা জাতীয় গবেষণাগারের এলাকার ভেতরে ভেসে উঠতে পারে।