ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা ঝাকিয়ে বলল, এ মিথ্যা কথা বলছে। এত সহজে কেউ পঞ্চম মাত্রার একটা মহাকাশযান ধ্বংস করে দেয় না।
কোনটি সহজ কোনটি কঠিন সে-ব্যাপারে তোমার এবং আমার মাঝে বিশাল পার্থক্য।
আমার কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযান ফোবিয়ান হঠাৎ করে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, মনে হলো পুরো মহাকাশযানটি বুঝি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, অশুভ একধরনের কর্কশ শব্দ পুরো মহাকাশযানের ভেতরে। প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।
ক্লদ আতঙ্কিত হয়ে বলল, ক্যাপ্টেন! আসলেই মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চাপা গলায় বলল, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে চল, দেখি কী হচ্ছে।
কথা শেষ করার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার পিছু পিছু ক্লদ এবং মুশ ছুটে বের হয়ে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিত্তিকার কাছে এগিয়ে গেলাম, তার ঘুমন্ত মুখটি স্পর্শ করে নরম গলায় বললাম, ঘুমাও মিত্তিকা। আমি দেখি তোমাকে বাঁচাতে পারি কি না।
আমি মিত্তিকার মাথার কাছে রাখা নিহিলা গ্যাস সিলিন্ডারটি তুলে নিলাম। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে, একটু খুঁজে সেটাও বের করে নিলাম। পোশাকের ভেতরে সেগুলো লুকিয়ে নিয়ে এবারে আমিও ছুটে চললাম নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে এখন আসল নাটকটি অভিনীত হবে। আমি তার মূল অভিনেতা। আমাকে থাকতেই হবে।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আমাকে দেখে ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতের ফাঁক দিয়ে কুৎসিত একটা গালি উচ্চারণ করে বলল, নির্বোধ আহাম্মক কোথাকার।
আমি অত্যন্ত সহজ একটা ভঙ্গি করে বললাম, এখন আমার কথা বিশ্বাস হলো? দেখেছ, মহাকাশযানটা ধ্বংস হতে যাচ্ছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চিৎকার করে বলল, না। ধ্বংস হচ্ছে না। আমি সেটাকে ফিরিয়ে আনব।
তুমি পারবে না।
দেখি পারি কি না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অভিজ্ঞ মহাকাশ-দস্যু মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে নিতে হয় সেটি খুব ভালো করে জানে। সে দ্রত কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর প্যানেল স্পর্শ করে মূল ইঞ্জিন দুটো পরিপূর্ণভাবে চার্জ করে নেয়। এখন ইঞ্জিন দুটো চালু করতেই প্রচণ্ড শক্তিশালী দুটো ইঞ্জিন মহাকাশযানটিকে সঠিক যাত্রাপথে নেয়ার চেষ্টা করবে। সেই ভয়ঙ্কর শক্তি মহাকাশযানটিকে প্রচণ্ড ত্বরণের মুখোমুখি এনে ফেলবে, মহাকাশযানের ভেতরে সেটি এক অচিন্ত্যনীয় মাধ্যাকর্ষণের জন্ম দেবে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস, ক্লদ আর মুশ সেই অচিন্ত্যনীয় মহাকর্ষণে অচেতন হয়ে পড়বে, কিন্তু আমাকে চেতনা হারালে চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি জানি না পারব কি না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেল স্পর্শ করার জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিল, আমি নিজেকে রক্ষা করার জন্যে নিচে লাফিয়ে পড়লাম, দুই হাত শক্ত করে দুইপাশে দুটি ধাতব রিং আঁকড়ে ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস সুইচ স্পর্শ করল এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল। আমার প্রথমে মনে হলো মহাকাশযানটি বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে না মহাকাশযানটি এখনো টুকরো টুকরো হয়ে যায় নি প্রচণ্ড ঝাকুনিতে মহাকাশযানের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে উড়ে গেছে মাত্র। আমি চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম বলে ম্যাঙ্গেল ক্বাস, ক্লদ বা মুশকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু কাতর চিৎকার শুনে বুঝতে পারছি তাদের কেউ-না-কেউ ছিটকে পড়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।
মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে শুরু করছে। পদার্থ-প্রতিপদার্থের শক্তিশালী ইঞ্জিন ভয়ঙ্কর গর্জন করে শব্দ করছে, আয়োনিত গ্যাস অচিন্ত্যনীয় গবিবেগে ছুটে বের হয়ে মহাকাশযানটিকে নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি মাধ্যাকর্ষণের টানে আমার ওজন বেড়ে যাচ্ছ, মনে হচ্ছে সমস্ত শক্তি দিয়ে অদৃশ্য কোনো দানব আমাকে মহাকাশযানের মেঝেতে চেপে ধরছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমার চোখের উপর একটা লাল পর্দা কাঁপতে শুরু করছে, মনে হচ্ছে আমি বুঝি এক্ষুনি অচেতন হয়ে পড়ব।
কিন্তু আমি জোর করে নিজের চেতনাকে শানিত করে রাখলাম, আমার কিছুতেই জ্ঞান হারানো চলবে না, আমাকে যেভাবেই হোক নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জেগে থাকতে হবে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে জেগে রইলাম।
আমি অনুভব করতে পারছি মহাকাশযানের প্রচণ্ড ত্বরণে আমার চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য শক্তি মুখের চামড়া দুইপাশে টেনে ধরেছে, হাত নাড়ানোর চেষ্টা করে নাড়াতে পারছি না, মনে হচ্ছে কেউ যেন পেরেক দিয়ে আমার সমস্ত শরীরকে মেঝের সাথে গেঁথে ফেলেছে, শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেউ যেন পিষে ফেলছে। নিজের শরীরের প্রচণ্ড চাপে আমার নিজের অস্তিত্ব যেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কষ্টে আমার মুখ শুকিয়ে যায়, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক হা হা করতে থাকে। মনে হয় কেউ যেন মহাকাশযান থেকে সমস্ত বাতাস শুষে নিয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও আমি একফোটা বাতাস বুকের ভেতরে আনতে পারি না। মাথার ভিতরে কিছু একটা দপদপ করতে থাকে, মনে হয় বুঝি এক্ষুনি একটা ধমনী ছিড়ে যাবে, নাক মুখ চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসবে।
আমি আর পারছি না, অনেক চেষ্টা করেও আর নিজের চেতনাকে ধরে রাখতে পারছি না। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে আসছে, চারপাশে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি যখন হাল ছেড়ে দিয়ে অচেতনতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন কে যেন আমাকে ডাকল, ইবান।