জান না? ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে বলল, কেমন ছিলে জান না? কী বলছ উলন?
উলন স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর শীতল গলায় বলল, কেমন করে জানব। ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ হলো, তারপর আর কিছু মনে নাই।
মনে নাই?
না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অন্যদের দিকে তাকাল, অন্যেরাও তখন মাথা নাড়ল, বলল, নাই, মনে নাই।
কিছু মনে নাই?
মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর বলল, না, মনে নাই।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না হঠাৎ করে ম্যাঙ্গেল ক্বাস রেগে উঠল কেন, গলার স্বর উঁচু করে বলল, আসলে মনে আছে, তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।
মাঝামাঝি বসে থাকা একজন মানুষ তখন ধীরে ধীরে উঠে এল, তার শরীরের একটা বড় অংশ বিকটভাবে পুড়ে গেছে, একটা হাত ভেঙে অসহায়ভাবে ঝুলছে, মানুষটির চেহারায় জগৎসংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা— ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছাকাছি এসে বলল, আমরা মিথ্যা কথা বলছি?
হ্যাঁ। আমার ধারণা তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।
কেন?
কারণ, তোমরা আমাকে বলবে না গ্লকোনাইটগুলো কোথায় আছে।
মানুষগুলো চুপ করে বসে এবং দাঁড়িয়ে রইল, তাদের দেখে মনে হলো তারা ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা বুঝতে পারছে না।
বল, কেথায় রেখেছ গ্লকোনাইটগুলো।
খিলা নামের মহিলাটি প্রথমে হেসে উঠল, প্রাণহীন আনন্দহীন ভয়ংকর একধরনের হাসি। তার হাসি শুনে অন্য আরো কয়েকজন হেসে উঠল এবং ম্যাঙ্গেল ক্বাস আরো রেগে উঠে, চিৎকার করে বলল, তোমরা বলবে না কোথায় আছে গ্লুকোনাইটগুলো?
মুখে নোংরা দাড়িগোঁফ একজন মানুষ উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা বেঁচে আছি না মারা গেছি সেটাই মনে নাই— আর গ্লকোনাইট!
উলন জিজ্ঞেস করল, থ্রকোনাইট কী?
ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবারে তার হাতে অস্ত্রটা তুলে নিয়ে সেটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তোমরা এখন বলতে চাও গ্লকোনাইট চেনো না?
ইরি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, হতে পারে চিনি কিংবা চিনি না। মনে নাই। আসলে কিছু মনে নাই।
আমাকে মনে আছে?
ইরি উত্তর না দিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাতের অস্ত্র উদ্যত করে দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমরা কি ভেবেছ আমি শুধু তোমাদের উদ্ধার করা জন্যে এসেছি?
পুরষ, মহিলা এবং না-পুরষ না-মহিলা কেউই কোনো কথা বলল না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস পা দাপিয়ে বলল, না, আমি শুধু তোমাদের উদ্ধার করার জন্যে এখানে আসি নাই। একটা মহাকাশযান দখল করে এই উদ্ভট উপগ্রহে কেউ শুধু মানুষকে উদ্ধার করার জন্যে আসে না। আমিও আসি নাই। আমি গ্লকোনাইটের জন্যেও এসেছি। বল কোথায় আছে। গ্লকোনাইট।
ইরি চিন্তিত মুখে বলল, দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে দেখি।
কাকে জিজ্ঞেস করবে?
ইরি কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। মনে হলো কিছু একটা নিয়ে সে হঠাৎ যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল কাকে জিজ্ঞেস করবে?
এ তো–ঐ যে, যারা–মানে– এই যে— ইরিকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখায়।
ম্যাঙ্গেল জ্বাস ভুর কুঁচকে তাকিয়ে রইল, তারপর হিংস্র গলায় বলল, বুঝেছি। তোমরা সহজ কথায় নড়বে না। আবার আমাকে একটা উদাহরণ তৈরি করতে হবে, যেন তোমাদের সব কথা মনে পড়ে।
আমি একধরনের আতংক নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্লাসের দিকে তাকালাম, সে এখন কী করতে যাচ্ছে?
ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতে দাত ঘঁষে বলল, আমি ঠিক দশ সেকেন্ড সময় দিলাম, তার মাঝে তোমরা যদি না বলো গ্লুকোমাইটগুলো কোথায় আছে তাহলে আমি তোমাদের একজনকে গুলি করে মারব।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার অস্ত্র উঁচু করে ধরল এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, সে সত্যিই দশ সেকেন্ড পর গুলি করবে। আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস— ।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস ধমক দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো এখন। আমি এখানে ধর্ম প্রচারে আসি নি। এদের একজন দুই জনকে গুলি করে মেরে না ফেলা পর্যন্ত—
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি কাকে মারতে চাইছ?
কেন? এদেরকে।
যারা মরে গেছে, তাদেরকে মারা যায় না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী বললে?
আমি চাপা গলায় বললাম, এরা সবাই মরে গেছে।
মরে গেছে?
হ্যাঁ। এই গ্রহে অক্সিজেন নেই, শুধু বিষাক্ত বাতাস। এই মানুষগুলো কেউ কোনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। দেখেছ?
নিঃশ্বাস নিচ্ছে না?
না।
তাহলে এরা কথা বলছে কেমন করে?
জানি না। আমার ধারণা–
তোমার ধারণা–
আমার ধারণা, এই মৃতদেহগুলোকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মাথা ঝাকিয়ে বলল, বাজে কথা বল না।
আমি বুঝতে পারলাম সে আমার কথা বিশ্বাস করল না, আমি বুঝতে পারলাম সে এখন এদের একজন-দুজনকে গুলি করবে। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম খিলা নামের মেয়েটা খুব ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একমাত্র এই দরজা দিয়ে বের হওয়া যায়, দরজাটি বন্ধ করে দিলে আর কেউ বের হতে পারবে না। সমস্ত শরীরের বেশিরভাগ পুড়ে যাওয়া মানুষটাও আমাদের অন্যপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। উলন এবং ইরিও উঠে দাঁড়িয়েছে— সবাই খুব ধীরে ধীরে আমাদেরকে ঘিরে ফেলছে। আমি মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম, সেগুলো কাচের চোখের মতো প্রাণহীন, নিষ্প্রভ। মানুষগুলোর চোখেমুখে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।
আমি সাবধানে এক পা পিছিয়ে এসে মিত্তিকার কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা।