কিছুক্ষণের মাঝেই খুব কাছাকাছি দুটো মোটরবাইক এসে থামল। মানুষগুলো অস্ত্র হাতে নেমে আসে। খাদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা বিধ্বস্ত জ্বলন্ত মোটরবাইকটা দেখার চেষ্টা করতে থাকে। একজন মাথা উচিয়ে জিজ্ঞেস করল, দেখা যাচ্ছে?
অন্যজন উত্তর করল, কী দেখতে চাও?
ছেলেটাকে।
কত গভীর খাদ দেখেছ? এখান থেকে দেখবে কেমন করে?
প্রথম মানুষটা চিন্তিত মুখে বলল, তা হলে ঈশ্বর ক্লডকে কী বলব?
যেটা সত্যি সেটাই বলব।।
সেটা কী? ছেলেটা বেঁচে আছে না মরে গেছে?
এখান থেকে পড়লে কেউ বেঁচে থাকতে পারে?
কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমরা তো কখনোই নিশ্চিত হতে পারব না।
আমরা না পারলেও ঈশ্বর ক্লড নিশ্চিত হবেন। ঈশ্বর ক্লড সব জানেন।
তা ঠিক।
মোটা গলার মানুষটা হেঁটে খাদের খুব কাছাকাছি গিয়ে বলল, যদি ছেলেটা বেঁচেও থাকে, এই মরুভূমিতে একা একা চব্বিশ ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারবে না।
তা ঠিক।
তোমার লটারির বুদ্ধি না শুনে তখনই যদি কানের নিচে একটা গুলি করে দিতাম তা হলে একটা মোটরবাইক নষ্ট হত না।
ছেলেটার কত বড় সাহস দেখেছ? প্রভু ক্লড মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন তার পরেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। লাভ হল কিছু?
একটা মোটরবাইক নষ্ট হল।
চল যাই।
খাদে নেমে কি দেখতে চাও?
দেখতে চাইলে দিনের বেলায় আসতে হবে। এখন অন্ধকারে নামা যাবে না।
তা ঠিক।
মানুষগুলো নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ফিরে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিহান মোটরবাইক দুটোর ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল। ফাঁকা মরুভূমিতে দীর্ঘ সময় সে সেই শব্দ শুনতে পায়, বহুদূর থেকে সেই শব্দ তার কাছে ভেসে আসছে।
মানুষগুলো চলে যাবার পর রিহান নিজেকে পরীক্ষা করে দেখল, শরীরের কোনো হাড় ভাঙে নি, কিছু জায়গা থেতলে গেছে, চটচটে রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। খানিকক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে রিহান বড় বড় নিশ্বাস নিল, তারপর উঠে বসল। এই এলাকা থেকে তাকে সরে যেতে হবে–যতদূর সম্ভব।
নক্ষত্রের আলোতে রিহান উত্তর দিকে হেঁটে যেতে শুরু করে, একটু পরপর তার মাথায় একটা অশুভ চিন্তা এসে ভর করতে থাকে, এই নির্জন নির্বান্ধব মরুভূমিতে সে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে? রিহান জোর করে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে রাখে।
সূর্যের আলো প্রখর না হওয়া পর্যন্ত সে হেঁটে গেল। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় তার ভেতরটুকু পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে, একটু পরপর ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে কিন্তু তবুও সে থামল না। যখন আর হাঁটতে পারছিল না তখন থেমে সে একটা বড় পাথরের উপরে উঠে চারদিকে দেখার চেষ্টা করে। দূরে কোথাও কোনো পরিত্যক্ত আবাসভূমি, গুদামঘর, ধসে যাওয়া ফ্যাক্টরি, বা অন্য কিছু আছে কি না খুঁজে দেখে। সূর্যের প্রখর আলোতে চারদিক ধিকিধিকি করে জ্বলছে। বহুদূরে পশ্চিমে কিছু ধসে যাওয়া বাড়িঘর আছে বলে মনে হল। সেগুলো পাথরের স্তূপও হতে পারে। এত দূর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। রিহান চারদিকে তাকিয়ে গাছপালা খোজার চেষ্টা করে কিন্তু কোথাও সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে পাথর থেকে নেমে আসে, কোনো একটা বড় পাথরের ছায়ায় সে এখন বিশ্রাম নেবে, সূর্য ঢলে গিয়ে অন্ধকার হওয়ার পর সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাবে।
প্রচণ্ড তৃষ্ণা এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে সে পাথরের ছায়ায় ঘুমানোর চেষ্টা করল। তার চোখে ঘুম এল না কিন্তু ভয়ংকর ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়েছিল বলে ছাড়া ছাড়া ভাবে মাঝে মাঝে ঘুমের মতো এক ধরনের অচেতনার অন্ধকারে ঢলে পড়ছিল, আবার ঘুম ভেঙে চমকে চমকে সে জেগে উঠছিল। ধীরে ধীরে সূর্যের আলো তীব্র হয়ে ওঠে, তার মাঝে রিহান একটা বড় পাথরের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। শরীরের নানা অংশ প্রচণ্ড ব্যথায় অসাড় হয়ে আছে, রিহান তার মাঝে সূর্য ঢলে পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। সূর্য ঢলে পড়ে তাপমাত্রাটা মোটামুটি সহনীয় হয়ে যাবার পর রিহান উঠে বসে তারপর নিজেকে টেনে টেনে এগিয়ে নিতে থাকে।
রিহান ভালো করে চিন্তা করতে পারে না, তার মনে হতে থাকে হয়তো তার প্রভু ক্লডের কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া উচিত তা হলে হয়তো মৃত্যুর আগে এক আঁজলা পানি খেতে পারবে। টলটলে ঠাণ্ডা পানি। চুমুক দিয়ে খাবার আগে সে হয়তো খানিকটা পানি নিজের মুখে ছিটিয়ে দিয়ে শীতল করে নেবে নিজের শরীরকে।
রিহান নিশ্বাস ফেলে চিন্তাটাকে মন থেকে দূর করে দেয়, তারপর ক্লান্ত দেহকে টেনে টেনে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পরপর তাকে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে, সে আর নিজেকে টেনে নিতে পারছে না। শরীরের সমস্ত চামড়া শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ক্ষতে মুখের ভেতরে এক ধরনের নোনা স্বাদ ছিল এখন সেখানে কোনো অনুভূতি নেই, জিবটা মনে হয় একটা শুকনো কাঠ। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে তার মাঝে ধুকে ধুকে সে নিজেকে টেনে নিতে থাকে। পশ্চিমে যে এলাকাটাকে সে ধসে যাওয়া প্রাচীন বাড়িঘর মনে করছে সেটা কতদূর সে জানে না, সেটা সত্যিই প্রাচীন বাড়িঘর কি না কিংবা সত্যি সত্যি সেখানে সে পৌঁছতে পারবে কি না সেটাও সে জানে না, তারপরেও সে এগুতে থাকে। নিজেকে টেনে নিতে নিতে মাঝে মাঝে সে দাঁড়িয়ে যায়, রাতের নানা বিচিত্র শব্দ শোনা যায় তখন, নিশ্বাস বন্ধ করে সে পরিচিত শব্দ শোনার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু শুনতে পায় না। গতীর রাতে বহুদূর থেকে সে একটা ইঞ্জিনের চাপা গর্জন শুনতে পেল। কিসের ইঞ্জিন? কোনো লোকালয়ের? কোথায় আছে তারা।