ছেলেটাকে খুলে এই খাদের কাছে নিয়ে এস–গুলি করে নিচে ফেলে দেব।
ঠিক আছে।
রিহান অনুভব করল দুজনে মিলে তার শরীরের বাধন খুলে ফেলছে, উত্তেজনায় তার বুক ধকধক করতে থাকে, যদি দেখে ফেলে সে হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে তা হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে, কিন্তু মানুষগুলো সেটা বুঝতে পারল না। কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা তাই সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো এখানে অন্ধকার। রিহান টের পেল তাকে ধরাধরি করে মানুষগুলো খাদের কাছে নিয়ে এসেছে, সে তার শরীর শক্ত করে রাখে, ঠিক বুঝতে পারছে না কী করবে। হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠে ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে? নাকি কাউকে জাপটে ধরে তার অস্ত্রটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে?
রিহান শুনল একজন বলল, কে গুলি করবে?
ভারী গলায় একজন বলল, আমি করবো না। আমার খুনোখুনি ভালো লাগে না।
অন্য একজন বলল, খুনোখুনি করতে কি আমাদের ভালো লাগে নাকি? করতে হয় বলে করি। মনে আছে সেবার কী হল তানিয়াকে নিয়ে?
রিহানের বুক ধকধক করতে থাকে, তানিয়া নামের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। তাকেও মেরে ফেলেছিল এরা? ঈশ্বর ক্লডের আদেশে? কী করেছিল তানিয়া?
আমি বলি কী—
কী?
লটারি করে বের করি কে গুলি করবে।
এই কাজের জন্যে লটারি করতে হবে। এই দ্যাখো আমি গুলি করি–
রিহান লাফিয়ে উঠে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে শুনতে পেল, আহা–এত তাড়া কীসের? করা যাক লটারি, মজা হবে খানিকটা। শেষ রাতে একটু মজা হোক না।
কীভাবে লটারি করবে?
এই যে পাথরটা কোন হাতে আছে বলতে হবে। যে হারবে সে গুলি করবে। কী বলো?
ঠিক আছে।
রিহান শুনতে পায় মানুষগুলো কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে গিয়ে লটারি করতে থাকে। এটাই তার সুযোগ—-শেষ সুযোগ। রিহান নিঃশব্দে হাত দিয়ে চোখের বাধা কাপড়টা খুলে তাকাল। এতক্ষণ চোখ বাঁধা ছিল বলেই কিনা কে জানে আবছা অন্ধকারে সে বেশ স্পষ্ট দেখতে পেল তিনটা মোটরবাইক পাশাপাশি দাঁড় করানো। দুটোর ইঞ্জিন বন্ধ করানো, তৃতীয়টি ধুকধুক করে চলছে। তার হেডলাইট জ্বালিয়ে খানিকটা আলোর ব্যবস্থা করা আছে। রিহান মনে মনে হিসেব করে সে যদি হঠাৎ করে মোটরবাইকটার ওপরে উঠে বসতে পারে তা হলে পালানোর একটা সুযোগ আছে। মানুষগুলো ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে একটু সময় লাগবে তার মাঝে সে অনেকদূর সরে যেতে পারবে। তখন সবাই মিলে তাকে গুলি করার চেষ্টা করবে, পিছু পিছু ধাওয়া করবে কিন্তু মনে হয় তার মাঝেও তার পালিয়ে যাবার একটা ভালো সম্ভাবনা আছে।
রিহান বুক ভরে একটা নিশ্বাস নেয়, হঠাৎ করে সে তার সারা শরীরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। চোখের কোনা দিয়ে সে মানুষ তিনজনকে দেখে তারপর সাবধানে উঠে গুঁড়ি মেরে মোটরবাইকটার দিকে এগুতে থাকে। আবছা অন্ধকার থাকায় মানুষগুলো প্রথম দুএক সেকেন্ড তাকে দেখতে পায় নি, হঠাৎ করে একজন তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। রিহান তখন লাফিয়ে উঠে ছুটে মোটরবাইকটার উপর বসে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে সোজা মানুষগুলোর দিকে ছুটে যায়। মানুষগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে সরে গেল এবং রিহান পোড়া টায়ারের গন্ধ ছুটিয়ে তাদের ভেতর দিয়ে গুলির মতো বের হয়ে গেল। মরুভূমির বিস্তৃত পাথুরে সমতলের উপর দিয়ে সে ছুটে যেতে থাকে, মরুভূমির শীতল বাতাসে তার চুল উড়তে থাকে, বাতাস চোখে–মুখে কেটে কেটে বসতে শুরু করে।
কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই সে গুলির শব্দ শুনতে পেল। তার কানের কাছ দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে বুলেট ছুটে যেতেই সে তার মোটরবাইকের হেডলাইট বন্ধ করে দিল। অন্ধকার অপরিচিত মরুপ্রান্তর, যে কোনো মুহূর্তে একটা বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে পড়তে পারে কিন্তু রিহান এই মুহূর্তে সেটি তার মাথা থেকে জোর করে সরিয়ে রাখল। রিহান মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল অন্য দুটি মোটরবাইক তাকে ধরার জন্যে ছুটে আসছে, ধরে না ফেললেও গুলির আওতায় পেয়ে যাবে কিছুক্ষণের মাঝে, তখন কী
মোটরবাইকটিকে এলোমেলোভাবে ছুটিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ করে রিহান হতবুদ্ধি হয়ে যায়, বিশাল একটা খাদের দিকে সে ছুটে যাচ্ছে। কী করছে চিন্তা না করেই সে চলন্ত মোটরবাইক থেকে লাফিয়ে পড়ল, প্রায় সাথে সাথে মোটরবাইকটা প্রায় উড়ে গিয়ে খাদের মাঝে পড়ে এবং কয়েক সেকেন্ড পরে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে সাথে আগুনের হলকা উপরে উঠে আসে।
রিহান প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দাতে দাঁত চেপে কোনোভাবে নিজেকে অচেতন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করল। কোনোভাবেই এখন তাকে অজ্ঞান হয়ে গেলে চলবে না। মানুষগুলো কয়েক মিনিটের মাঝে এখানে চলে আসবে, তার মাঝে তাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। যেভাবে হোক।
রিহান মাটিতে ঘষে ঘষে প্রায় সরীসৃপের মতো নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকে। বড় বড় কিছু পাথর আছে কয়েক মিটার দূরে, তার পিছনে চলে যেতে পারলে সে নিজেকে লুকিয়ে নিতে পারবে। শরীরের কোনো হাড় ভেঙেছে কি না সে জানে না, কপালের এক পাশ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে বাম চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে একটা কালো পরদা নেমে আসতে চাইছে বারবার, অনেক কষ্টে রিহান নিজেকে জাগিয়ে রেখে নিজেকে টেনে নিতে থাকে। অমানুষিক একটা পরিশ্রম করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে সে বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগল।