তুমি সেটি পরীক্ষা করেছ?
জি মহামান্য প্রভু ক্লড।
প্রভু ক্লড বললেন, তুমি জান তুমি একটি খুব বড় অপরাধ করেছ। যে প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের পুরো সভ্যতাটি গড়ে উঠেছে তুমি সেই প্রক্রিয়াটিকে অবিশ্বাস করেছ। অসম্মান করেছ।
রিহান কাতর গলায় বলল, আমি বুঝতে পারিনি, মহামান্য প্রভু।
যে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, তুমি সেই যন্ত্রকে অসম্মান করেছ।
আমার ভুল হয়েছে। রিহান মাথা নিচু করে বলল, আপনি আমাকে শাস্তি দিন।
প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী শাস্তি চাও?
আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব।
প্রভু ক্লড একটি নিশ্বাস ফেলে কঠোর গলায় বললেন, আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম।
রিহান ভয়ংকর আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে ওঠে। দুই হাত জোড় করে কাতর গলায় বলল, না, প্রভু না। আমাকে অন্য কোনো শাস্তি দিন। আমাকে বেঁচে থাকতে দিন। একটিবার মাত্র একটিবার সুযোগ দিন
প্রভু ক্লড স্থির দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিহান মাথা নিচু করে ভাঙা গলায় বলল, আমায় ক্ষমা করুন প্রভু। ক্ষমা করুন। আমি ভুল করেছি, আর আমি ভুল করব না। আমাকে মাত্র একটিবার সুযোগ দিন
রিহান মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। প্রভু ক্লড ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রিহান পাগলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় হাহাকার করে বলল, প্রভু ক্লড! প্রভু—প্রভু–
হঠাৎ করে রিহান অনুভব করে তার দুইপাশ থেকে দুজন তাকে শক্ত করে ধরেছে। রিহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, মুখে রঙ মাখা দুজন মেয়ে। ধাতব রঙের চুলগুলো মাথার উপরে চুড়োর মতো করে বাঁধা। মেয়ে দুটো আলগোছে একটা করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে।
রিহান উন্মাদের মতো ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। ঠিক তখন কে জানি তার মাথায় পিছন থেকে আঘাত করে।
চোখের সামনে তার সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। গভীর বিষাদে তার হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। এই কি তা হলে মৃত্যু?
মরুভূমি
মোটরবাইকের এক ধরনের কর্কশ শব্দ শুনতে শুনতে রিহান জ্ঞান ফিরে পেল। তার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি এবং মুখের উপর বাতাসের ঝাঁপটা–তাকে নিশ্চয়ই মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে একটা স্ট্যান্ডের সাথে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রিহান চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, নিশ্চয়ই কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। মরুভূমির শীতল বাতাসে তার শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়, তার ভেতরে যন্ত্রণায় শরীরের ভেতরে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে মাথাটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। হাত দুটো পেছনে শক্ত করে বাঁধা, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত দুটোতে কোনো অনুভূতি নেই বলে মনে হচ্ছে। রিহান কান পেতে শুনল–আশপাশে একাধিক মোটরবাইকের শব্দ। একসাথে বেশ কয়েকজন তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কে জানে। রিহান হাত দুটো নাড়িয়ে বাধনটা একটু ঢিলে করার চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না কিন্তু হঠাৎ করে রক্ত সঞ্চালনের একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল।
রিহানের সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার সে চেতনা হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু তার ভিতরেও অনেক কষ্টে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখল। তাকে কারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে জানে না, কিন্তু অনুমান করতে পারে–নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবে হাতের বাধন খুলতে পারলে তবুও সে বাচার একটা শেষ চেষ্টা করতে পারে। রিহান আবার চেষ্টা করে দেখল, বাঁধনটা খুলতে পারল না কিন্তু মনে হয় একটু ঢিলে হল। রিহান নিশ্বাস বন্ধ করে চেষ্টা করতে থাকে, বাঁধনটা না খুলেও সে যদি কোনোভাবে একটা হাত বের করে আনতে পারে তা হলেও সে একবার বাঁচার চেষ্টা করে দেখতে পারে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করে সে বাম হাতটাকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে, হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায় তবু সে হাল ছাড়ে না, একসময় মনে হতে থাকে সে বুঝি কখনোই পারবে না তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে লেগে রইল। যখন মনে হল আর কিছুতেই পারবে না তখন হঠাৎ করে বাম হাতটা খুলে এল। সাথে সাথে হাতের তীব্র যন্ত্রণাটা ম্যাজিকের মতো কমে যায়, অন্ধকারে হাত ঘষে ঘষে রিহান হাতের মাঝে রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে।
রিহান শুনতে পেল যারা মোটরবাইক চালাচ্ছে তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছে মোটরবাইকের প্রচণ্ড শব্দে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল না, রিহানের মনে হল তারা কোথাও থামার কথা বলছে। দেখা গেল সত্যিই তাই, তার মোটরবাইকটা খানিকটা ঘুরে বেশ হঠাৎ করেই থেমে গেল। রিহান বাঁধা অবস্থায় অচেতন হয়ে থাকার ভান করে, বুঝতে পারে তার দুই পাশে আরো দুটি মোটরবাইক থেমেছে এবং সেখান থেকে মানুষগুলো নেমে এসেছে। একজন বলল, জ্ঞান হয়েছে নাকি?
রিহান গলার স্বরটি চিনতে পারল না, সে দুই হাত একসাথে করে অচেতন হওয়ার ভান করে রইল। ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ সহজে বুঝতে পারবে না তার হাতগুলো খোলা। রিহান অনুভব করল একজন মানুষ সাবধানে তাকে স্পর্শ করে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, না, এখনো অজ্ঞান হয়ে আছে।
জ্ঞান আর ফিরবে না। জানতেই পারবে না কী হয়েছে– কথাটা খুব ভালো একটা রসিকতা এরকম ভঙ্গি করে মানুষটা উচ্চ স্বরে হেসে উঠল, কিন্তু অন্য কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না।