রিহান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
সামনে গেলেই দরজা দেখতে পাবে। দরজা খুলে ঢুকে যাও। দৃনা একমুহূর্ত থেমে বলল, আর শোন, কখনোই সরাসরি প্রভু ক্লডের চোখের দিকে তাকাবে না।
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে, তাকাব না।
প্রভু তোমাকে অনুমতি দিলেই শুধু কথা বলবে, নিজে থেকে একটি কথাও বলবে না।
বলব না।
মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করবে।
ঠিক আছে দৃনা।
বের হবার সময় কখনো প্রভুর দিকে পিছন দেবে না।
দেব না।
মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না।
রিহান মাথা নেড়ে বলল, দাঁড়াব না।
হে প্রভু ক্লড, হে ঈশ্বর-পুত্র বলে তাকে সম্বোধন করবে।
ঠিক আছে দৃনা।
যাও। এবার ভেতরে যাও।
রিহান একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, তুমি কি জান প্রভু ক্লড আমাকে কেন ডেকেছেন?
দৃনা বলল, না, জানি না।
রিহান কাতর গলায় বলল, না, আমার খুব ভয় করছে। তুমি কি আমার জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে?
দৃনা তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, যাও। ভেতরে যাও।
রিহান একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর সাহস সঞ্চয় করে বিশাল আর. ডি. টির দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে একটু উপরে একটি দরজা। দরজাটি বন্ধ, হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই দরজাটি খুলে গেল। ভেতরে হালকা নীল রঙের একটা আলো জ্বলছে। রিহান নিশ্বাস নিতেই ক্ষীণ বাসি ফুলের মতো এক ধরনের গন্ধ পেল। রিহানের বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে, তার ভেতর কোনোভাবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দৃনা তাকে মাথা তুলে তাকাতে নিষেধ করেছে, সে মাথা তুলে তাকাল না। লাল নরম কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর, ভি.য়ের অন্যপাশে হঠাৎ কাপড়ের এক ধরনের খসখসে শব্দ শুনতে পায়–রিহান মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকাতে সাহস পেল না, মাথা নিচু করে অভিবাদন করল।
রিহান শুনল প্রভু ক্লড বললেন, আমার দিকে তাকাও, ছেলে তোমার চেহারাটা দেখি।
ভারী ভরাট গলা, ঘরে তার কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। দৃনা সোজাসুজি প্রভু ক্লডের দিকে তাকাতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু রিহান প্রভু ক্লডের আদেশ অমান্য করতে সাহস পেল না। রিহান মাথা তুলে ক্লডের দিকে তাকাল, দুজন প্রথমবারের মতো দুজনকে দেখতে পেল।
প্রভু ক্লডের মাথায় ধবধবে সাদা চুল এবং দাড়ি, পরনে লম্বা সাদা আলখাল্লা। মুখে বয়সের বলিরেখা, চোখ দুটো আশ্চর্য রকম নীল। তার চোখের দৃষ্টি এত তীব্র যে রিহান বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না, সে চোখ নামিয়ে নিল।
প্রভু ক্লড জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে, তোমাকে আমি কেন ডেকেছি জান?
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, না, প্রভু ক্লড, আমি জানি না।
তুমি অনুমান করতে পার?
পারি না প্রভু ক্লড। আমি অনুমান করতে পারি না।
প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ শীতল গলায় বললেন, গত পরশু দিন তুমি পাওয়ার স্টেশনে কী করেছিলে?
রিহানের হঠাৎ বুক কেঁপে উঠল, সে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠে বলল, প্রভু ক্লড, ঈশ্বরপুত্র, আমার ভুল হয়েছিল। আমার খুব বড় ভুল হয়েছিল।
প্রভু কুড হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ভুল না শুদ্ধ আমি তোমার কাছে সেটি জানতে চাইছি না ছেলে–আমি জানতে চেয়েছি সেখানে কী হয়েছিল।
আপনি সব জানেন প্রভু।
তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
রিহান তবু চুপ করে রইল, তখন প্রভু ক্লড কঠিন গলায় বললেন, বলো।
রিহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, পাওয়ার স্টেশনের সামনে আমার ডিউটি পড়েছিল প্রভু ক্লড, হঠাৎ সেটা অদ্ভুত এক রকম শব্দ করতে লাগল। কয়েকটা যন্ত্র থেমে কেমন যেন সংকেতের মতো শব্দ বের হতে লাগল। তখন– রিহান কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায়।
বলো ছেলে। তখন কী হল?
আমি তখন পাওয়ার স্টেশনের কাছে গেলাম।
একটি নবম মাত্রার যন্ত্রের কাছে তুমি অনুমতি না নিয়ে গেলে? অপবিত্রভাবে গেলে? সম্মান প্রদর্শন না করে গেলে?
রিহান কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভু ক্লড শীতল গলায় বললেন, তারপর কী হল?
আমি আমি পাওয়ার স্টেশনটি পরীক্ষা করে দেখলাম। দেখলাম একটা পানির টিউব ফেটে গেছে, পানি যাচ্ছে না। স্টেশনটি গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন– রিহান আবার চুপ করে যায়।
তখন? তখন কী?
রিহান মাথা তুলে কাতর গলায় বলল, আমাকে ক্ষমা করুন। প্রভু ক্লড–ক্ষমা করুন।
প্রভু ক্লড কঠিন গলায় বললেন, তখন কী?
রিহান ভাঙা গলায় বলল, তখন আমি পানির পাইপটা পাল্টে দিয়েছি।
কী দিয়ে পাল্টে দিয়েছ?
পুরোনো ট্রাকে সেরকম একটা পাইপ ছিল, সেটা খুলে।
তুমি কী দিয়ে খুলেছ?
আমার কাছে একটা প্লায়ার্স ছিল।
তুমি কোথায় পেয়েছ প্লায়ার্স?
রিহান পুরোপুরি ভেঙে গিয়ে বলল, যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে চুরি করেছি প্রভু ক্লড।
কেন চুরি করেছ?
আমার–আমার
তোমার কী?
আমার যন্ত্রপাতি দিয়ে খেলতে ভালো লাগে প্রভু ক্লড। যন্ত্র কেমন করে কাজ করে আমার জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে– কথা বলতে বলতে রিহানের গলা ভেঙে গেল। সে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়, দুই হাত জোড় করে অনুনয় করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু ক্লড। হে ঈশ্বরপুত্র হে করুণাময়
প্রভু ক্লড নরম গলায় বললেন, রিহান–
গলার স্বর শুনে রিহান চমকে উঠে আশান্বিত চোখে প্রভু ক্লডের দিকে তাকাল, বলুন প্রভু।