রিহান এবার রেগে উঠতে শুরু করল, অনেক কষ্ট করে রাগটা প্রকাশ করতে না দিয়ে বলল, জানমালের ক্ষতি হতে পারে? কোর্ট এই যুক্তি গ্রহণ করেছে?
আমাদের বিচারকরা মামলাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছেন। তারা অনেকক্ষণ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই মুহূর্তে এই প্লেন চালানো বেআইনি এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকর।
রিহানের মুখ রাগে থমথমে হয়ে ওঠে, সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, জনস্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকর?
হ্যাঁ।
কীভাবে সেটা ক্ষতিকর?।
গ্রুস্তান হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ঐ সব ঘুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে পরে শুনানি হবে। তুমি তখন বিচারকদের সামনে তোমার কথাগুলো বলার সুযোগ পাবে। তোমাকে সেটা বলার জন্যে ডাকা হবে।
রিহান এবার রাগে ফেটে পড়ল, ককপিটের দরজা খুলে সে লাফিয়ে নিচে নেমে পা দাপিয়ে বলল, তোমরা ফাজলেমি পেয়েছ? এরকম একটা ব্যাপার নিয়ে তোমরা ঠাট্টা গ্রু করেছ?
এটা মোটেও ঠাট্টা নয়। গ্রুস্তান কষ্ট করে মুখে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলল, কোর্টের সিদ্ধান্তকে ঠাট্টা বললে তোমার ওপর কোর্ট অবমাননার অভিযোগ আনা যায়।
কোর্ট অবমাননা?
কোর্ট অবমাননার শাস্তি হচ্ছে কারাদণ্ড। তোমাকে তা হলে আমাদের জেলখানায় এক সপ্তাহ আটকে রাখতে হবে। গ্রুস্তান সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, এক দিক দিয়ে তা হলে ভালোই হয়–আমাদের জেলখানাটা একটু ব্যবহার হয়! এতদিন হল জেলখানা তৈরি করেছি এখনো একজনকে ঢোকাতে পারলাম না! তোমাকে দিয়ে শুরু করলে মন্দ হয় না–
রিহান হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তোমরা মনে হয় ব্যাপারটা ধরতে পারছ না। আইন তৈরি করা হয় মানুষকে সাহায্য করার জন্যে, কারো ক্ষতি করার জন্যে নয়!
আমরা কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করছি না।
ক্ষতি করার চেষ্টা করছ না? এত দিন চেষ্টা করে আমরা একটা প্লেন দাঁড় করিয়েছি, সবকিছু প্রস্তুত, আমরা যাচ্ছি ফিড টেস্ট করতে ঠিক সেই মুহূর্তে এসে তোমরা এটাকে আটকে দিলে! কার বিরুদ্ধে সেটা করলে? আমার বিরুদ্ধে! আমি–রিহান, যে নাকি একা তোমাদের সবার বিরুদ্ধে থেকে সবার জন্যে তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেছি। যে তথ্য পেয়ে আগে একজন মানুষ ঈশ্বর হয়ে যেত এখন কমিউনের যে কোনো মানুষ তার থেকে একশ গুণ বেশি তথ্য পেতে পারে। কে তার ব্যবস্থা করেছে? আমি! সেই আমার বিরুদ্ধে তোমরা ষড়যন্ত্র শুরু করেছ?
গ্রুস্তান গম্ভীর গলায় বলল, আইনের চোখে সবাই সমান। তুমি পৃথিবীর সব মানুষের জন্যে তথ্য সরবরাহ করে ঈশ্বর–ঈশ্বরীর ব্যাপারটা শেষ করে দিয়েছ সেজন্যে আমরা সবাই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা স্কুলের জন্যে যে ইতিহাস বই লিখছি সেখানে তোমার ওপরে একটা চ্যাপ্টার আছে কিন্তু মনে করো না সেজন্যে তোমাকে আইনের চোখে আলাদাভাবে দেখা হবে। একজন নাগরিক মামলা করেছে আমাদের সেই মামলাটা বিবেচনা করতে হয়েছে। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
এই নাগরিকটা কে জানতে পারি?
তুমি নিয়মমাফিক আবেদন করলে কোর্ট তোমাকে এই সুনাগরিকের নাম জানাতে পারে।
রিহান চোখ পাকিয়ে বলল, দেখো গ্রুস্তান, ভালো হবে না বলছি। কে এই সুনাগরিক?
প্রিমা। গ্রুস্তানের মুখ হঠাৎ কৌতুকের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! তোমার বিবাহিত স্ত্রী, কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে তাকে আমরা একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করেছি। একবারও তোমার স্ত্রী হিসেবে দেখি নি–
রিহান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না, তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, প্রিমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
গ্রুস্তান সহৃদয়ভাবে রিহানের হাত ধরে বলল, মাথা খারাপ হবে কেন? তোমাকে একশবার বলেছে তুমি শোন নি, একটা প্লেন তো আর ছেলেখেলা নয়। অ্যাকসিডেন্ট তো হতেই পারে–
তাই বলে কোর্টে!
আহা–হা। এত কষ্ট করে আমরা একটা আইন বিভাগ দাঁড় করিয়েছি কেউ যদি ব্যবহার না করে তা হলে কেমন করে হবে? বিচারকদের কথা চিন্তা কর–বেচারারা রীতিমতো ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছে কিন্তু এখন কোনো কাজ নেই। প্রিমার মামলার কারণে তবু শেষ পর্যন্ত একটা কাজ পেয়েছিল। সবার কী উৎসাহ তুমি যদি দেখতে?
রিহান মাথা থেকে হেলমেট খুলে ককপিটের ভেতরে রেখে হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, প্রিমা কোথায়?
মনে হয় স্কুলে।
চলো যাই। দেখি অনুরোধ করে মামলাটা তুলিয়ে নেওয়া যায় কি না।
.
স্কুলটা তৈরি করা হয়েছে খুব সুন্দর করে। সাদা দেয়ালের ওপর লাল টাইলের ছাদ। চারপাশে গাছের ছায়া। পাহাড়ের উপর থেকে একটা ঝরনা নেমে এসেছে, পাথরের উপর দিয়ে স্বচ্ছ পানিটুকু ঝিরঝির করে গড়িয়ে যাচ্ছে, শব্দটুকু ভারি সুন্দর। রিহানের কোনো কাজ না থাকলে সে পানিতে পা ডুবিয়ে বড় একটা পাথরে বসে থাকে। কিছুদিন হল কিছু পাখি এসে এখানে ভিড় জমিয়েছে, তাদের কিচিরমিচির শুনতে বেশ লাগে!
রিহান স্কুলের ভেতর ঢুকে ক্লাসরুমগুলোতে উঁকি দিল, বারো তেরো বছরের কিছু ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে প্রিমা কী একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করছিল, রিহানকে দেখে বলল, কী ব্যাপার রিহান? কাজ শেষ?
রিহান রাগের ভান করে বলল, তোমার কী মনে হয়?
প্রিমা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, কেমন জব্দ হলে আজ? আমাদের বিচার বিভাগের ক্ষমতা দেখলে?