হ্যাঁ।
আ–আমার সাথে?
হ্যাঁ। তোমার সাথে। গ্রাউস শীতল গলায় বলল, এখন বলো, কেন?
রিহানের হঠাৎ মনে হতে থাকে তার হাঁটুতে কোনো জোর নেই। এর আগে যারা প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে গিয়েছে এবং কখনো ফিরে আসে নি হঠাৎ করে তাদের কথা মনে পড়ে যায়। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে কোনোমতে দুই পা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে তার মনে হতে থাকে কেউ বুঝি তার সারা শরীরের শক্তি শুষে নিয়েছে। সে কাঁপা গলায় বলল, বিশ্বাস কর গ্রাউস, আমি কিছু করি নি
গ্রাউস কিছুক্ষণ রিহানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তাই যেন সত্যি হয় রিহান।
রিহান এক ধরনের কাতর গলায় বলল, আমি এখন কী করব গ্রাউস?
গ্রাউস জোর করে একবার হাসার চেষ্টা করে বলল, প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ কী করবে? তুমি এক্ষুনি দেখা করতে যাও। প্রভু ক্লড তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
কেমন করে যাব গ্রাউস?
আর্মাড কারের লাল দরজার সাসনে গিয়ে দাঁড়াও, ভেতর থেকে এসে তোমাকে ডেকে নেবে।
রিহান তবুও দেয়াল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে রইল। গ্রাউস কঠিন গলায় বলল, যাও রিহান। দেরি কোরো না।
রিহান অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর ঘুরে লরির দরজা খুলে বের হয়ে এল। পাটাতন থেকে নিচে নেমে এসে সে তাদের আস্তানার মাঝখানে তাকায়, ছয়টি আর্মাড কার বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভেতরে প্রভু ক্লডের নিজস্ব আর, ভি,, বাইরে থেকে কখনো সেটা দেখা যায় না। রিহান অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকায়, এই এলাকাটি মরুভূমির মতো, রাত্রিবেলা আকাশটি একেবারে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ঝকঝক করতে থাকে। আকাশের অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে, প্রতিদিন দেখার পরও নক্ষত্রগুলোকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। মরুভূমির শুকনো হাওয়া বইছে, বাতাসের শব্দটি কেমন যেন হাহাকারের মতো শোনায়, কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে রিহানের বুকের ভেতর বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করে। রিহান কয়েক মুহূর্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, মরুভূমির শীতল বাতাসের জন্যেই কিনা কে জানে হঠাৎ তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বুকের ভেতরে আটকে থাকা চাপা একটা নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে রিহান সামনে এগিয়ে যায়। বড় আর্মাড কারের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে তার নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে থাকে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, রাতের অন্ধকারে বড় বড় লরি এবং ট্রাকগুলোকে অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো মনে হয়। চারদিকে জমাট–বাধা অন্ধকার এবং নিঃশব্দ, শুধুমাত্র পাওয়ার স্টেশন থেকে চাপা গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ আসছে। রিহানের মনে হতে থাকে বড় বড় লরির জানালা দিয়ে অন্ধকারকে আড়াল করে সবাই তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে, সবার চোখে আতঙ্ক। হঠাৎ তার ইচ্ছে হতে থাকে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু তার সাহস হয় না। সে স্থাণুর মতো আর্মাড কারের লাল দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
রিহান কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, হঠাৎ খুট করে দরজাটা খুলে গেল, ভেতরে আবছা অন্ধকার তার মাঝে রিহান শুনতে পেল নারী কন্ঠে কেউ তাকে চাপা গলায় ডাকল, ভেতরে এস।
রিহান সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসতেই কাচক্যাচ শব্দ করে পিছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। রিহান ভিতরে তাকাল, আসবাবপত্রহীন একটি ধাতব কন্টেইনার। কন্টেইনারের ঠিক মাঝখানে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটির পোশাক খুব সংক্ষিপ্ত এবং সেই পোশাকের ভেতর দিয়ে তার সুগঠিত শরীর দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির ধাতব রঙের চুলগুলো বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। মেয়েটির চোখের পাতায় নীল রঙ, ঠোঁট দুটো টকটকে লাল। যে কোনো হিসেবে মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু চেহারায় কোনো এক ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে সেটি কী রিহান ঠিক ধরতে পারল না। মেয়েটির বুকের উপরে বুলেটের একটি বেল্ট, ডান হাতে তৃতীয় মাত্রার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আলগোছে ধরে রাখা। মেয়েটি শুকনো এক ধরনের খসখসে গলায় বলল, রিহান, তুমি দুই হাত পাশে ছড়িয়ে রেখে এক পা এগিয়ে এস।
গলার স্বর শুরে রিহান হঠাৎ করে মেয়েটিকে চিনতে পারল, মেয়েটি দৃনা, ছয় নম্বর লরিতে থাকত, আজ থেকে চার বছর আগে হঠাৎ করে একদিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য! দৃনা এখানে? প্রভু ক্লডের কাছে? রিহান চাপা গলায় বলল, দৃনা! তুমি এখানে? আমরা ভেবেছিলাম
দৃনা রিহানকে বাধা দিয়ে যান্ত্রিক গলায় বলল, দুই হাত পাশে ছড়িয়ে এগিয়ে এস।
রিহান থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে হতচকিত ভাবে দৃনার দিকে তাকাল, ভাবলেশহীন এক ধরনের মুখ, সেখানে অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই। রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে এক পা এগিয়ে আসে। দৃনা দক্ষ মানুষের মতো রিহানের শরীর সার্চ করে, নির্বিকারভাবে তার জম্মদেশ, বুকে, পিঠে হাত দিয়ে দেখে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে বলল, আমার সাথে এস।
রিহান হাঁটতে থাকে। সামনে আর্মাড কারের দরজা খুলে রিহান বের হয়ে আসতেই প্রভু ক্লডের বিশাল আর. ভি. টি দেখতে পেল। জানালায় হালকা নীল আলো জ্বলছে, উপরে কয়েকটি বিচিত্র ধরনের এন্টেনা, দেখে মনে হয় কোনো ধরনের স্থাপত্যকর্ম। দৃনা নিচু গলায় বলল, যাও।