রিহানকে কেমন জানি অপ্রস্তুত দেখাল, সে নিচু গলায় বলল, আমাকে কিছু খেতে দিতে পারবে? খুব খিদে লেগেছে–সারা দিন কিছু খাই নি আমি।
৮. মুখোমুখি
রিহান মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বড় একটা ট্রাকে হেলান দিয়ে একজন প্রহরী ঝিমুচ্ছিল, সে চমকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তাক করে বলল, কে? কে যায়?
রিহান হাঁটার গতি এতটুকু না কমিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আমার নাম রিহান।
দাঁড়াও। দাঁড়াও না হলে গুলি করে দেব।
রিহান মুখে হাসি টেনে বলল, কেন খামোখা গুলি করে একটা বুলেট নষ্ট করবে। আমি এমন কিছু ভয়ংকর মানুষ নই।
মানুষটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে, কী বলবে বুঝতে পারে। রিহান মুখের হাসিটা ধরে রেখে বলল, এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে? আমি তো এখানেই ছিলাম। মনে নেই?
মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, রি–হান? তুমি?
হ্যাঁ। তোমরা সবাই আমাকে ধরার জন্যে গিয়েছিলে খবর পেয়েছি। খুব দুঃখিত আমি ছিলাম না। খবর পেয়েই চলে এসেছি।
তুমি কেন এসেছ?
তোমাদের কাছে ধরা দিতে। রিহান দুই হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও বেঁধে ফেলো।
মানুষটি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও, এক সেকেন্ড দাঁড়াও
মানুষটি তার অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ছুটে যেতে থাকে। রিহান মুখে কৌতুকের এক ধরনের ভাব ধরে রেখে ইতস্তত পায়চারি করতে থাকে। একসময় সে এখানেই ছিল, এলাকাটা বেশ ভালো করে জানে, কোন ট্রাকে কে থাকে, কোন লরিটি কোন পরিবারের এখনো মনে আছে, ইচ্ছা করলেই কোথাও গিয়ে সে দরজায় শব্দ করে বলতে পারে, এই যে, আমি রিহান, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।
কিন্তু সে কিছুই করল না, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণের ভিতর গ্রাউস এবং তার সাথে আরো তিন–চার জন সশস্ত্র মানুষকে দেখা গেল, মানুষগুলো দ্রুত রিহানকে ঘিরে ফেলল। গ্রাউস রিহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, রিহান!
হ্যাঁ গ্রাউস। ভালো আছ?
গ্রাউস প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, তুমি কেন এসেছ?
প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে।
গ্রাউস চমকে উঠে বলল, কী বললে?
বলেছি প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে।
গ্রাউস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার সাহস খুব বেশি হয়েছে রিহান?
মনে হয় আগের থেকে একটু বেশি হয়েছে। মনে আছে তুমি আগেরবার যখন প্রভু ক্লডের কাছে পাঠাচ্ছিলে তখন আমি কী ভয় পেয়েছিলাম? এখন আমি নিজেই দেখা করতে চাইছি! খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভঙ্গি করে রিহান হা–হা করে হাসতে লাগল।
তুমি কেমন করে জান প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করবেন?
আমি জানি। সবাই আমাকে দেখতে চায়। তোমরা কয়েক হাজার মানুষ কি আমার খোঁজে যাও নি?
গ্রাউস কোনো কথা না বলে ক্রোধের এক ধরনের শব্দ করল। রিহান সেটা না শোনার ভান করে বলল, যদি প্রভু ক্লড দেখা করতে না চান তাকে বলো তার জন্যে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এনেছি।
কী তথ্য?
যেমন মনে কর আলোর ব্যাপারটি। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। তার গতিবেগ সেকেন্ডে তিন শ হাজার কিলোমিটার।
গ্রাউস কিছু বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান সহৃদয় ভঙ্গি করে হেসে বলল, কিংবা মনে কর নিউক্লিয়ার রি–এক্টরের ব্যাপারটি। এর ভেতরে কী হয় তুমি জান? ফুয়েল রডে কী থাকে তুমি জান? নিশ্চয়ই জান না। আমি কিন্তু জানি! প্রভু ক্লডকে আমি এই তথ্যগুলো দিতে চাই। গ্রাউস, এসব ব্যাপারে তোমার কোনো কৌতূহল না থাকতে পারে, প্রভু ক্লডের অনেক কৌতূহল। কেন জান?
গ্রাউস রিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। রিহান হাসি হাসি মুখ করে বলল, প্রভু ক্লডের অনেক কৌতূহল, কারণ তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো এইসব কথা জানার কথা না। কিন্তু তুচ্ছ মানুষ হয়ে আমি এসব জেনে গেছি!
ঠিক এরকম সময়ে দেখা গেল একজন মানুষ ছুটতে ছুটতে আসছে, কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মহামান্য গ্রাউস। প্রভু ক্লড এই মুহূর্তে রিহানকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন।
রিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, দেখেছ গ্রাউস, আমি তোমাকে বলেছিলাম না! প্রভু ক্লড আমাকে না দেখে থাকতেই পারবেন না।
আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে তাকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। রিহান তখন এগিয়ে যেতে রু করে, কোথায় যেতে হবে কীভাবে যেতে হবে সে জানে। রিহান হেঁটে যেতে যেতে বুঝতে পারে আশপাশের সব ট্রাক লরি থেকে মানুষজন বের হয়ে এক ধরনের অবিশ্বাস্য বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যে মানুষটি ঈশ্বরের মৃত্যুদণ্ডকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর ভয় না করে সেই মৃত্যুদণ্ড নিতে নিজে থেকে ফিরে আসে তাকে নিয়ে সবার যে এক ধরনের কৌতূহল হতে পারে তাতে অবাক হবার কী আছে?
.
রিহান সোজা হয়ে প্রভু ক্লডের দিকে তাকিয়ে রইল। এই অল্প কয়েকদিনে মনে হয় প্রভু ক্লডের মুখে বয়সের একটি ছাপ পড়েছে। প্রভু ক্লড তীব্র দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে হিংস্র গলায় বললেন, তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাইছ!