বেঁচে থাকার এক কঠিন প্রক্রিয়ায় তাদের সাহায্য করে তাদের নিজস্ব ঈশ্বর। কিংবা ঈশ্বরী।
১. প্রভু ক্লড
রিহান আধো ঘুমের মাঝে অনুভব করল কেউ একজন তার কাঁধে আলতোভাবে স্পর্শ করেছে। মুহূর্তের মাঝে রিহানের ঘুম ভেঙে যায়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে ধরে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, কে?
মানুষটি নিচু গলায় বলল, আমি।
রিহান অস্ত্রটি নিচে নামিয়ে রেখে বলল, ও! তুমি? মানুষটি তাদেরই একজন, প্রতি রাতে সে পাহারার ডিউটি ভাগাভাগি করে দেয়। মাঝরাতে একবার ঘুরে ঘুরে দেখে সবাই ঠিকমতো তাদের ডিউটি করছে কি না। রিহান অপরাধীর মতো বলল, বসে থাকতে থাকতে চোখে ঘুম চলে এসেছিল।
মানুষটি উত্তর না দিয়ে নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করল।
রিহান বলল, আর হবে না, দেখে নিও।
মানুষটি আবার নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বলল, চল।
রিহান ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায়?
গ্রাউসের কাছে।
গ্রাউস! রিহান চমকে উঠে বলল, গ্রাউসের কাছে কেন? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো এরকম হবে না। আমি বসবই না–
আহ! মানুষটি হাত তুলে রিহানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সেজন্য নয়। তুমি ডিউটিতে জেগে আছ না ঘুমিয়ে আছ সেটা নিয়ে গ্রাউস মাথা ঘামায়?
তা হলে কী জন্যে ডাকছে?
আমি কেমন করে বলব? মানুষটি হাত নেড়ে বলল, গ্রাউস আমাকে কখনো বলবে?
রিহান অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, মানুষটি ঠিকই বলেছে। গ্রাউস তাদের দলপতি, এতজন মানুষের দায়িত্ব তার ওপর। তাদের মতো ছোটখাটো মানুষের জন্য গ্রাউসের দেখা পাওয়াই একটি কঠিন ব্যাপার। তারপরও সে চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই জান না কেন ডেকেছে? আন্দাজও করতে পারবে না?
না। এখন এটা নিয়ে সময় নষ্ট কোরো না। তাড়াতাড়ি চল। গ্রাউস অপেক্ষা করছে।
রিহান ইতস্তত করে বলল, এখানে ডিউটি করবে কে?
মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, সে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার কাছে অস্ত্রটা দিয়ে তুমি যাও, তাড়াতাড়ি।
রিহান অস্ত্রটি মানুষটির হাতে দিল, মানুষটি সেটা হাতে নিয়ে তার কপালে স্পর্শ করে তারপর ম্যাগাজিনে ঠোঁট স্পর্শ করে সম্মান প্রদর্শন করে। এটি দ্বিতীয় মাত্রার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই সম্মান প্রদর্শন করা যায়। লেজার গাইডেড স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো হাতে নিলে হাঁটু গেড়ে সম্মান দেখাতে হয়।
রিহান দুশ্চিন্তিত মুখে আবছা অন্ধকারে তাদের আস্তানার দিকে হাঁটতে থাকে। তাদের আস্তানায় সব মিলিয়ে সাতচল্লিশটি নানা আকারের ট্রাক আর লরি রয়েছে। কাটাতার দিয়ে ঘিরে তার ভেতরে ট্রাকগুলো গোল করে ঘিরে রাখা হয়েছে, হঠাৎ করে কোনো দল আক্রমণ করলে চট করে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। রিহান হেঁটে হেঁটে গ্রাউসের লরিটা খুঁজে বের করল, এটি তুলনামূলকভাবে বড়, ইঞ্জিনটি শক্তিশালী। রিহান পেছনের দরজায় শব্দ করতেই সেটা খুট করে খুলে গেল। ভেতরে হলুদ রঙের একটা অনুজ্জ্বল আলো জ্বলছে, গ্রাউস দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, এস রিহান। ভিতরে এস।
রিহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের মুখের ভাবভঙ্গি লক্ষ করার চেষ্টা করল, মানুষটির মুখে বড় বড় দাড়ি–গোফ, চোখ দুটো স্থির এবং ভাবলেশহীন, দেখে মনের ভাব বোঝা যায় না।
রিহান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে ডেকেছ গ্রাউস?
হ্যাঁ। গ্রাউস আরো কিছু বলবে ভেবে রিহান অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু গ্রাউস কিছু বলল না, একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।
রিহান একটু ইতস্তত করে বলল, আমাকে কেন ডেকেছ?
তোমাকে দেখার জন্যে।
রিহান অবাক হয়ে বলল, আমাকে দেখার জন্যে?
হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম তুমি আরো বড়। কিন্তু তুমি তো দেখছি একেবারে বাচ্চা ছেলে।
রিহান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, না মহামান্য গ্রাউস, আমি মোটেও বাচ্চা ছেলে নই। গত শীতে আমার বয়স সতের হয়েছে। আমি এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালাতে অনুমতি পেয়েছি। রিকি বলেছে আমাকে একটা মোটরবাইক দেবে। আট সিলিন্ডারের।
গ্রাউস কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথাগুলো শুনেছে কি না রিহান ঠিক বুঝতে পারল না। কী কারণ জানা নেই, রিহান হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে, চাপা এক ধরনের ভয় হঠাৎ তার ভেতরে দানা। বাধতে শুরু করে। গ্রাউস আবার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, রিহান।
বলো, গ্রাউস।
তুমি কী করেছ?
আমি? রিহান চমকে উঠে বলল, আমি কী করব?
কিছু কর নি?
রিহান দ্রুত চিন্তা করতে থাকে, সে কি অস্বাভাবিক বা অন্যায় কিছু করেছে? তেরো নম্বর লরিটির হাসিখুশি কিশোরী মেয়েটির সাথে একটু ঠাট্টা-মশকরা করেছে, লরির দেয়ালে চেপে ধরে একটু চুমু খাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই বয়সের ছেলেমেয়েরা তো সেটা করেই। থাকে, সেটা তো এমন কিছু বড় অন্যায় নয়। মেয়েটা রাগ হবার ভান করেছে কিন্তু আসলে তো রাগ হয় নি, একটু পরেই তো লরির উপর থেকে তার মাথায় আধ বোতল গ্যাসোলিন। ঢেলে হি হি করে হেসেছে।
মনে করতে পারছ না?
গ্রাউসের কথায় চমকে উঠে রিহান বলল, না গ্রাউস। আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস কর
গ্রাউস হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে তীব্র গলায় বলল, তা হলে কেন প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?
রিহান আতঙ্কে শিউরে উঠে গ্রাউসের দিকে তাকাল, কথাটি শুনেও যেন বুঝতে পারছে, কিংবা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, প্রভু ক্লড আ–আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?