মানুষটা এবার ঈশিতার দিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করল এবং ঈশিতা তখন বুঝতে পারল, এই মানুষটি আসলে ভয়ংকর একটি মানুষ। মানুষটি তার কালচে জিবটা বের করে ওপরের ঠোঁটটা চেটে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, শোনো মেয়ে, এখন আসল কথায় চলে আসি। মানুষটি এতক্ষণ আপনি করে কথা বলছিল, এখন তুমিতে নেমে এসেছে—আমাদের কেউ প্রশ্ন করে না, দরকার হলে আমরা প্রশ্ন করি। বুঝেছ?
ঈশিতা কথা না বলে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটি বলল, কাজেই আমি কে, কী করি, কেন এসেছি, জানতে চেয়ো না। ঠিক আছে?
ঈশিতা মাথা নাড়ল, না, ঠিক নেই।
মানুষটা এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, বিষয়টা ঠিক আছে কি নেই, সেটা তুমি খুব সহজে পরীক্ষা করে দেখতে পার। তুমি যদি চাও, আমরা তোমাকে এখন তুলে নেব, ভোর রাতে মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে ফেলে যাব। একটু সুস্থ হয়ে তুমি পুলিশে কেস করার চেষ্টা করবে। তুমি দেখবে যে পুলিশ তোমার কেস নিচ্ছে না। খুব বেশি হলে পত্রপত্রিকায় একটু লেখালেখি করাতে পারবে কিন্তু দেখবে তার পরও কিছুই করতে পারবে না। চ্যালেঞ্জটা নিতে চাও?
ঈশিতা মাথা নেড়ে জানাল, সে নিতে চায় না। মানুষটা বলল, গুড। টেবিলে ল্যাপটপটা দেখিলে বলল, এটা তোমার?
হ্যাঁ।
এনডেভারের ওপর যে রিপোর্টটা লিখছ, সেটা এখানে আছে?
হ্যাঁ।
হ্যাঁ।
কাগজগুলো?
এই ব্যাগটাতেই আছে।
গুড। মানুষটি ব্যাগসহ ল্যাপটপটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, আমি এটা নিতে এসেছি।
ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, নিতে এসেছেন? আমার ল্যাপটপ?
হ্যাঁ। তোমার এডিটর সাহেবকে বলব দরকার হলে তোমাকে আরেকটা ল্যাপটপ কিনে দিতে।
মানুষ দুজন উঠে দাঁড়াল, দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে মধ্যবয়স্ক মানুষটি দাঁড়িয়ে যায়। ঘুরে নুরুল ইসলাম আর ঈশিতা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, আরও একটা কথা। এনডেভার নিয়ে যদি তোমরা বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখাও, তাহলে—কথা শেষ না করে সে হাত দিয়ে গলায় পোচ দেওয়ার ভঙ্গি করল।
মানুষ দুজন ভারী জুতোর শব্দ তুলে করিডর ধরে হেঁটে চলে গেল। লোকগুলো চোখের আড়াল হওয়ার পর ঈশিতা হতবাক হয়ে বলল, মগের মুল্লুক? আমার ল্যাপটপটা নিয়ে চলে গেল?
নুরুল ইসলাম নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ল্যাপটপ! শোনো ঈশিতা, খুব অল্পের ওপর দিয়ে গিয়েছে।
অল্পের ওপর দিয়ে?
হ্যাঁ।
এরা কারা?
নুরুল ইসলাম ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, জিজ্ঞেস কোরো না।
এনডেভারের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক।
এনডেভারের নাম মুখেও আনবে না।
ঈশিতা ইতস্তত করে বলল, আজকে এনডেভারের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে, আপনি শুনতে চান?
নুরুল ইসলামের মুখে আতঙ্ক এসে ভর করল, না, শুনতে চাই না। এনভেডার নিয়ে কী লিখতে হবে, তার একটা রিপোর্ট দিয়ে গেছে।
সেটা কোথায়?
নুরুল ইসলাম টেবিলের ওপর থেকে একটি কাগজ হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলেন। ঈশিতা কয়েক লাইন পড়ে নুরুল ইসলামের কাছে ফিরিয়ে দিল। বিশ্বের সেরা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণদের সমন্বয়ে কীভাবে ভবিষ্যতের নিউরাল কম্পিউটার গড়ে তুলবে, তার আকর্ষণীয় একটি বর্ণনা আছে। একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের কী ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে এবং সেই দায়বদ্ধতার কারণে তারা এই দেশের দুস্থ শিশুদের স্বাস্থ্যশিক্ষা আর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কী কী কাজ করেছে, তার একটি বিশাল বর্ণনা আছে। ঠিক কী কারণ, জানা নেই। ঈশিতা তার একটি কথাও বিশ্বাস করল না।
গভীর রাতে ঈশিতা যখন অফিস থেকে বের হয়ে নিজের মোটরসাইকেলে উঠেছে, সে টের পেল দূরে একটি গাড়ির হেড লাইট জ্বলে উঠেছে। যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন দেখতে পেল, গাড়িটি একটি দূরত্ব রেখে তার পেছনে পেছনে আসছে।
গাড়িটা কিছুই করল না। শুধু তার পেছনে পেছনে হোস্টেল পর্যন্ত এল, যখন সে ভেতরে ঢুকে গেল, গাড়িটা কিছুক্ষণ বাসার সামনে অপেক্ষা করে চলে গেল।
এরা কারা, ঈশিতা জানে না। কিন্তু এদের কাজকর্মে কোনো গোপনীয়তা নেই, কোনো লুকোছাপা নেই। এরা কাউকে ভয় পায় না। এই দেশে তাদের জন্য কোনো আইন নেই।
০৩. টঙে বসে চা খেতে খেতে
টঙে বসে চা খেতে খেতে রাফি শারমিনকে লক্ষ করে। যারা চা খেতে আসছে, সে কাপে করে তাদের চা দিয়ে আসছে। প্লেটে করে শিঙাড়া, জিলাপি, বিস্কুট দিচ্ছে। চা খাওয়ার পর কাপ-পিরিচ নিয়ে আসছে, বিল দেওয়ার সময় হলে সে নিখুঁতভাবে কার কত টাকা বিল দিতে হবে, বলে দিচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষের কার কত টাকা বিল হচ্ছে, সে কেমন করে মনে রাখছে, কে জানে।
রাফির কাপ-পিরিচ নেওয়ার সময় সে জিজ্ঞেস করল, আমার কত বিল হয়েছে?
শারমিন একটুও চিন্তা না করে বলল, সতেরো টাকা।
ঠিক করে হিসাব করেছ?
শারমিন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল। শারমিনের বাবা একটি গ্যাসের স্টোভে কড়াইয়ে জিলাপি ভাজছিল, রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, শারমিন হিসাবে ভুল করে না।
ভেরি গুড। রাফি পকেট থেকে একটি বিশ টাকার নোট বের করে শারমিনের হাতে দিয়ে বলল, বাকিটা তোমার।
মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। এই দেশের মানুষ এখনো মুখ ফুটে ধন্যবাদ বলা শুরু করেনি। যখন ধন্যবাদ বলার কথা, তখন সেটা মুখের হাসি দিয়ে বোঝাতে হয়।
শারমিনের বাবা গরম জিলাপি কড়াই থেকে তুলে চিনির সিরায় ড়ুবাতে ড়ুবাতে বলল, আমার শারমিন যেকোনো হিসাব মাথার মাঝে করে ফেলতে পারে।