ঈশিতার মাথায় রক্ত উঠে গেল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, সভ্যতার কথা থাক। আমি তোমার সঙ্গে সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমি কখনোই একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিক্রেতার কাছে যাব না। অন্য কোথাও যাব।
ঈশিতা বুঝে গেল, এটি হচ্ছে বেল্টের নিচে আঘাত। এই আঘাতের পর ইন্টারভিউ চলার কথা নয়; এবং সত্যি সত্যি আর চলল না। বব লাস্কি উঠে দাঁড়াল। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, তুমি এখন বিদায় হও।
ঈশিতাও উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে কাগজগুলো তুলতে তুলতে বলল, বাংলাদেশে গত কিছুদিনে অসাধারণ দুটি ব্যাপার ঘটেছে, একটা হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন। এই দেশে এখন সরকার যেকোনো তথ্য দিতে বাধ্য। আমাদের মতো সাংবাদিকদের ভারি মজা এখন পুলিশ বলো, কাস্টমস বলো, সবার কাছ থেকে খবর বের করতে পারি। দ্বিতীয়টা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। না বুঝে এই দেশের মানুষ এখন ভয়ংকর ভয়ংকর খবর ইন্টারনেটে দিয়ে রাখে!
বব লাস্কি কিছু বলল না। ঈশিতা হেঁটে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার কেন ডিভোর্স হয়েছে, সেটাও–
বব লাস্কি চিৎকার করে বলল, তুমি কেমন করে জান?
জানতাম না। এখন জানলাম। ঈশিতা মিষ্টি করে হাসে, সাংবাদিকেরা অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য জানে। শুধু শুধু!
মোটরসাইকেলটা চালিয়ে ঈশিতা যখন তার অফিসে ফিরে আসছে, তখন সে বুঝতে পারল, কাজটা ভালো হলো না। সম্পাদক নুরুল ইসলাম বারবার করে বলে দিয়েছেন, এদের ঘাটাবে না, বিরক্ত করবে না। দরকার হলে তোষামোদ করবে। অথচ সে ঠিক উল্টো কাজটা করে এসেছে। বব লাস্কিকে ঘটিয়েছে, বিরক্ত করেছে, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করেছে, ভয় দেখিয়েছে, অপমান করেছে। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে টিটকারি মেরেছে। সে এইটুকুন পুচকে একটা মেয়ে, কেন তার মাথায় এ রকম দুর্বুদ্ধি হলো? চাকরিটা মনে হয় গেল।
রাত এগারোটার সময় ঈশিতা নুরুল ইসলামের টেলিফোন পেল। তিনি হিমশীতল গলায় বললেন, ঈশিতা, তুমি কোথায়?
ঈশিতা মেয়েদের একটা হোস্টেলে থাকে। সে বলল, হোস্টেলে।
হোস্টেলটা কোথায়?
মণিপুরী পাড়ায়।
তোমার একটু অফিসে আসতে হবে।
ঈশিতা একটু অবাক হয়ে বলল, এখন?
কেন? সমস্যা আছে?
না, নেই। গাড়ি পাঠাব?
ঈশিতা বলল, না, গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি আসছি। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাব।
আমার ব ঈশিতা টেলিফোন রেখে দিচ্ছিল। তখন নুরুল ইসলাম বললেন, আর শোনো–
বলুন।
আজকের অ্যাসাইনমেন্টের কাজ কোথায় করছ?
আমার ল্যাপটপে।
ল্যাপটপটা নিয়ে এসো। যদি কোনো কাগজে নোট নিয়ে থাক, তাহলে কাগজগুলোও নিয়ে এসো। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
রাত এগারোটায় রাস্তাঘাট ফাঁকা, ঈশিতা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোটরসাইকেলে খবরের কাগজের অফিসে পৌঁছে গেল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যেত, কয়েক মিনিট দেরি হলো। সে মেয়েদের যে হোস্টেলে থাকে, তার কিছু নিয়মকানুন আছে। এত রাতে কেন বের হচ্ছে, সেগুলো দারোয়ান আর সুপারকে বোঝাতে তার কিছু বাড়তি সময় লেগেছে।–খবরের কাগজের অফিস ভোরবেলা ঢিলেঢালাভাবে শুরু হয়, রাতের দিকে সেটা রীতিমতো জমজমাট থাকে। রাত গভীর হওয়ার পর সেটা আবার ফাঁকা হতে শুরু করে। ঈশিতা যখন অফিসে পৌঁছেছে, তখন সেটা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। নুরুল ইসলামের অফিস তিনতলায়, লিফটে করে উঠে করিডর ধরে তার অফিসে যেতে যেতে সে দেখতে পেল, তার অফিসে দুজন মানুষ বসে আছে।
দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে ঈশিতা বলল, আসব?
এসো। নুরুল ইসলাম একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসো।
ঈশিতা ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে চেয়ারটায় বসে। সাধারণ সামাজিক নিয়মে এখন নুরুল ইসলামের এই দুজন লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন না, চুপচাপ বসে রইলেন। মানুষ দুজন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন মধ্যবয়স্ক, অন্যজনের বয়স একটু কম। দুজনেই হাস্যকর এক ধরনের সাফারি কোট পরে আছে। এই পোশাকটি কে আবিষ্কার করেছে, আর বাংলাদেশের মানুষ কেন এটি পরে, বিষয়টি ঈশিতা কখনোই ভালো করে বুঝতে পারেনি। মানুষ দুজনের চুল ছোট করে ছাঁটা, পেটা শরীর, মুখে এক ধরনের কাঠিন্য।
ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নুরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে ডেকেছেন!
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, আসলে আমরা ডাকিয়েছি।
ঈশিতা এবার ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল। মানুষটি বলল, বাংলাদেশে কত দিন থেকে ক্রসফায়ারে মানুষ মারা হচ্ছে, আপনি জানেন?
ঈশিতা প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠল। ইতস্তত করে বলল, সব মিলিয়ে বছর দশেক হবে।
কত মানুষকে মারা হয়েছে?
কয়েক হাজার।
আমাদের সংবিধান কি এই মার্ডারকে অ্যালাও করে?
না।
এটা নিয়ে কি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে? হিউম্যান রাইটস গ্রুপ কি চেঁচামেচি করেছে?
হ্যাঁ, করেছে।
কোনো লাভ হয়েছে?
ঈশিতা বলল, না, হয়নি।
তার মানে কি আপনি জানেন?
ঈশিতা দুর্বল গলায় বলল, না, জানি না।
তার মানে হচ্ছে, পৃথিবীর সব দেশে দেশের আইন মানার প্রয়োজন হয়, সে রকম একটা বাহিনী থাকে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য তারা দ্রুত ডিসিশন নিতে পারে। দ্রুত সেই ডিসিশন কার্যকর করতে পারে।
মানে মানুষ মার্ডার করতে পারে?
আরও অনেক কিছু করতে পারে।
ঈশিতা জিব দিয়ে তার শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে বলল, আপনারা গভীর রাতে ডেকে এনে আমাকে এসব বলছেন কেন? আপনারা কারা?