ঈশিতা বলল, প্রয়োজন হয়নি। কিংবা তোমার মুখে এই উচ্চারণটিই হয়তো সবাই পছন্দ করে।
মানুষটা ঈশিতাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসায়। চেয়ারের সামনে একটি টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে আরেকটি চেয়ারে বসে বলল, বলো, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?
ঈশিতা বলল, বব লাস্কি, আমাকে পাঠানো হয়েছে, তোমার একটি ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য। তোমরা এই দেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে যাচ্ছ। কাজেই আমরা তোমাদের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই।
বব লাস্কি চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমরা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার। সাদা ভাষায় তোমরা কম্পিউটার বলতে যা বোঝাও, সেই কম্পিউটার না। আমরা বিশেষ কাজ মাথায় রেখে কম্পিউটার তৈরি করি। এক ধরনের সুপার কম্পিউটার। আর্কিটেকচার সম্পূর্ণ আলাদা, নিউরাল নেটওয়ার্ক–
ঈশিতা ইতস্তত করে বব লাস্কিকে থামিয়ে বলল, আমি গত বিশ মিনিট তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডেস্কে রাখা কাগজপত্র থেকে এগুলো জেনে গেছি। আমি আসলে তোমার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু জানতে চাই।
বব লাস্কির মুখ কঠিন হয়ে উঠল, ঈশিতা মোটামুটি স্পষ্ট ভাষায় তাকে জানিয়ে দিয়েছে, তুমি আমাকে বাইরে বিশ মিনিট অপেক্ষা করিয়েছ। এই মানুষটি এটিও পছন্দ করেনি, স্বাভাবিক ভদ্রতা দাবি করে এখন সে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। বব লাস্কি দুঃখ প্রকাশ করল না। বলল, তুমি আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কী জানতে চাও?
বাংলাদেশে কেন?
বব লাস্কি সরু চোখে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। নিউরাল নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার ব্যবহার করে বিশেষ ধরনের কাজ করার উপযোগী সুপার কম্পিউটার তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ যে সঠিক দেশ নয়, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি চালাক-চতুর হতে হয় না। কাজেই ঈশিতার প্রশ্নটা এমন কোনো দুর্বোধ্য প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু বব লাস্কি ভান করল, প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি। বলল, আমি তোমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারিনি।
ট্রপিক্যাল ডিজিজ গবেষণার জন্য বাংলাদেশ চমৎকার একটি দেশ হতে পারে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও এটা চমৎকার জায়গা। জাহাজশিল্প কিংবা ফুড প্রসেসিংও হতে পারে। কিন্তু সুপার কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারিং? বাংলাদেশে? কেন? কীভাবে?
বব লাস্কি এবার খুব হিসাব করে কথার উত্তর দিল। বলল, তোমার দেশে এক শ পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ, সারা পৃথিবীর সব মানুষের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। মানুষের বুদ্ধিমত্তা পৃথিবীতে সমানভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কাজেই তোমাদের দেশে অসংখ্য মেধাবী ছেলেমেয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া এই ছেলেমেয়েগুলোকে আমরা ব্যবহার করতে চাই। তাদের নিয়ে নিউরাল নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচারের বিশ্বমানের গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে চাই।
ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, আমিও ঠিক এটা ভেবেছিলাম। কিন্তু—
কিন্তু?
তোমরা এখানে আছ এক বছর থেকে বেশি সময়, রেকর্ড টাইমে চৌদ্দতলা এই বিশাল বিল্ডিং তৈরি করেছ, কিন্তু এখন পর্যন্ত এই দেশের কোনো ছেলে বা মেয়েকে নিয়োগ দাওনি।
বব লাস্কির মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে যায়, শীতল গলায় বলে, নিয়োগ দেওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি।
সম্ভবত। ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, আমার আরেকটা প্রশ্ন। তোমাদের এই বিশাল বিল্ডিংটা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারের ল্যাবরেটরির মতো না। এটা অনেকটা হাসপাতালের মতো। কারণ কী?
তুমি কেমন করে জান? সিকিউরিটির কারণে বাইরের কেউ এখানে ঢুকতে পারে না। তোমাকেও নিশ্চয়ই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একটা বিল্ডিংকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কথা নয়, এটা হাসপাতাল, না ক্যাসিনো! তোমার কেন ধারণা হলো, এটা হাসপাতালের মতো?
ঈশিতা বলল, আমাকে যখন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়, তখন সেখানে যাওয়ার আগে আমি খুব ভালো করে হোমওয়ার্ক করে আসার চেষ্টা করি। এবার সময় বেশি পাইনি, তাই হোমওয়ার্কটা শেষ করতে পারিনি, যেটুকু পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে—
বব লাস্কি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার হোমওয়ার্ক ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে।
অসম্পূর্ণ বলতে পার, কিন্তু ভুল বলাটা ঠিক হবে না। আমি কীভাবে হোমওয়ার্কটা করার চেষ্টা করেছি, শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে।
কীভাবে করেছ?
যে কন্ট্রাক্টর তোমার বিল্ডিংটা তৈরি করেছে, তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই বিল্ডিংয়ের একটা ফিচার হচ্ছে অক্সিজেনের লাইন। শুধু হাসপাতালে ঘরে ঘরে অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে হয়! সে জন্য অনুমান করেছি–
তোমার অনুমান ভুল। বব লাস্কি অনেক চেষ্টা করেও তার গলার স্বরে ক্রোধটাকে লুকিয়ে রাখতে পারল না, হিংস্র গলায় বলল, কন্ট্রাক্টরের এসব কথা বলা হচ্ছে সম্পূর্ণ অনুচিত এবং বেআইনি। আমাদের দেশ হলে সে। পুরোপুরি ফেঁসে যেত।
ঈশিতা বব লাস্কির মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা পুরোপুরি উপভোগ করতে শুরু করে। মুখের হাসিটা আরও একটু বিস্তৃত করে বলল, শুধু কন্ট্রাক্টর নয়, কাস্টমসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তোমাদের এই বিল্ডিংয়ে কনটেইনার বোঝাই মেডিকেল ইকুইপমেন্ট আসছে। দামি দামি ইকুইপমেন্ট। এই দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালও যে ইকুইপমেন্ট আনার কথা চিন্তাও করতে পারে না, তোমরা সেই ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসেছ। কেন?
বব লাস্কি অনেকক্ষণ শীতল চোখে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে বাধ্য নই। তুমি আমার কাছে যে বিষয়গুলো জানতে চাইছ, সেই জিনিসগুলো তোমার জিজ্ঞাসা করার কথা নয়। পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশ হলে—