রানা মুখভঙ্গি করে বলল, হুম! সাবধান রাফি। ছাত্রীরা যখন বলে কিউট, তখন সাবধানে থাকতে হয়।
সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে টঙের দিকে যেতে থাকে। পাশাপাশি অনেকগুলো টং। রানা খানিকটা ধারাবিবরণী দেওয়ার মতো করে বলল, এই যে টংগুলো দেখছ, তার মধ্যে প্রথম যে টংটা দেখছ, সেখানে কখনো যাবে না।
কেন?
এটা যে চালায়, সে হচ্ছে জামাতি। এইখানে রড-কিরিচি এগুলো লুকিয়ে রাখা হয়। যখন হল অ্যাটাক করে, তখন এখান থেকে সাপ্লাই দেওয়া হয়।
ইন্টারেস্টিং!
পরের টংগুলোতে যেতে পারো। সেকেন্ড টং খুব ভালো পেঁয়াজো ভাজে। থার্ড টঙের রং-চা ফার্স্ট ক্লাস। ফোর্থ টঙে গরম জিলাপি পাবে। আমরা সাধারণত এই জিলাপি খেতে যাই। তুমি জিলাপি খাও তো?
হ্যাঁ, খাই।
কম বয়সী লেকচারাররা দল বেঁধে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেসব ছাত্রছাত্রী সেখানে বসেছিল, তারা উঠে একটু পেছনে সরে গেল। যে মানুষটি জিলাপি ভাজছে, সে গলা উঁচিয়ে বলল, এই শারমিন, স্যারদের বেঞ্চ মুছে দে।
বেঞ্চগুলো মোছর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটি এক ধরনের তোষামোদ। শারমিন নামের মেয়েটি একটা ন্যাকড়া দিয়ে বেঞ্চগুলো মুছে দিল। মেয়েটির বয়স বারো কিংবা তেরো—মায়াকাড়া চেহারা, এই বয়সে মেয়েদের চেহারায় এক ধরনের লাবণ্য আসতে শুরু করে।
কম বয়সী লেকচারাররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে, প্লেটে করে গরম জিলাপি আনা হয়। সবাই খেতে খেতে গল্প করে।
হঠাৎ রানা বলে, ওই যে সমীর যাচ্ছে। ডাকো সমীরকে। একজন গলা উঁচিয়ে ডাকল, সমীর! জিলাপি খেয়ে যাও।
সমীর অন্যদের সমবয়সী, উশকোখুশকো চুল এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রানা গলা নামিয়ে বলল, সমীর হচ্ছে আমাদের মধ্যে হার্ডকোর সায়েন্টিস্ট। বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। ভাইরাস আর ব্যাক্টেরিয়া ছাড়া কোনো কথা বলে না।
রানার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যই কি না কে জানে, সমীর এসেই বলল, তোরা আজকের খবরের কাগজ দেখেছিস?
রানা জানতে চাইল, কেন, কী হয়েছে?
খুব বাজে একটা ভাইরাস ডিটেক্ট করেছে। ইনফ্যাক্ট, এটা ভাইরাস না প্রিওন, তা এখনো সিওর না।
প্রিওনটা কী জিনিস?
কবির বলল, থাক থাক! এখন প্রিওন-ফ্রিওনের কথা থাক। জিলাপি খা। গরম জিলাপি খেলে সব ভাইরাস শেষ হয়ে যাবে।
ঠাট্টা নয়, খুব ডেঞ্জারাস।
সমীর খুব গম্ভীর মুখে বলল, সরাসরি ব্রেনকে অ্যাফেক্ট করে। আমাদের দেশের জন্য ব্যাড নিউজ।
কেন, আমাদের দেশের জন্য ব্যাড নিউজ কেন?
কোনো রকম প্রটেকশন নেই। কোনোভাবে ইনফেক্টেড একজন আসতে পারলেই এপিডেমিক শুরু হয়ে যাবে।
কবির বলল, থাক থাক, পৃথিবীর সব ভাইরাসের জন্য তোর দুশ্চিন্তা করতে হবে না, অন্যদেরও একটু দুশ্চিন্তা করতে দে। তুই জিলাপি খা।
সমীর খুব দুশ্চিন্তিত মুখে জিলাপি খেতে থাকে। সবাই উঠে পড়ার সময় কবির জিলাপি তৈরি করতে থাকা মানুষটিকেজিজ্ঞেস করল, আমাদের কত হয়েছে?
মানুষটা কিছু বলার আগেই শারমিন নামের মেয়েটি বলল, একেক জনের তেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
সুহানা জিজ্ঞেস করল, সব মিলিয়ে কত?
চুরানব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
আমি দিয়ে দিচ্ছি।
কবির বলল, তুই কেন দিবি?
আজ আমাদের নতুন কলিগ এসেছে, তার সম্মানে।
রানা বলল, আর আমরা এত দিন থেকে আছি, আমাদের কোনো সম্মান নেই?
সম্মান দেখানোর মতো এখনো কোনো কারণ খুঁজে পাইনি! সুহানা তার ব্যাগ থেকে এক শ টাকার একটা নোট বের করে শারমিনের হাতে দিয়ে বলল, নাও। বাকিটা তোমার। মেয়েটির মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে।
সবাই মিলে যখন ওরা হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে, তখন সুহানা রাফিকে বলল, শারমিন মেয়েটাকে দেখেছ?
হ্যাঁ। কী হয়েছে?
কত বিল হয়েছে জানতে চাইলেই সে একটা আজগুবি সংখ্যা বলে দেয়। কেন বলে, কে জানে!।
রাফি অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। টঙের কাছে গাছের ওপর একটা কাগজে জিলাপি, সিঙাড়া, বিস্কুট এবং চায়ের দাম লেখা আছে। সে ভেবেছিল, বিলটা দিয়ে দেবে, তাই মনে মনে হিসাব করছিল, কত হয়েছে। সবাই মিলে যা খেয়েছে, সেটা হিসাব করলে সত্যিই চুরানব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়। সাতজনের মধ্যে ভাগ করলে সেটা আসলেই মাথাপিছু তেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়। শারমিন আজগুবি কিছু বলেনি, নিখুঁত হিসাব করেছে।
রাফি তখনো জানত না, এই বাচ্চা মেয়েটির কারণে আর কিছুদিনের মধ্যেই তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটবে।
০২. বল পয়েন্ট কলম
নুরুল ইসলাম টেবিলে বল পয়েন্ট কলমটা অন্যমনস্কভাবে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, ঈশিতা।
বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা ঈশিতা বলল, বলেন।
বিকেলটা ফ্রি রেখো।
কেন?
তোমাকে এনডেভারের অফিসে যেতে হবে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
কেন?
নুরুল ইসলাম দেশের জনপ্রিয় একটা পত্রিকার সম্পাদক, পত্রিকা কীভাবে চালাতে হয়, সেটা খুব ভালো জানেন কি না, সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারে কিন্তু ব্যবসা জানেন কি না, সেটা নিয়ে কেউ সন্দেহ করে না। টেলিফোন কোম্পানির ওপর কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হওয়ার পর থেকে কোম্পানিগুলো তার পত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়। কৃতজ্ঞতাবশত, নুরুল ইসলামও তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বন্ধ রেখেছেন। এ মুহূর্তে তাঁর পত্রিকায় ব্যাংকগুলো নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হচ্ছে। তিনি ব্যাংকের জিএমদের কাছ থেকে ফোন পেতে শুরু করেছেন, মনে হচ্ছে তাদের থেকেও নিয়মিত বিজ্ঞাপন আসতে থাকবে। নুরুল ইসলাম ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, এনডেভারের সিইওর একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে।