কম কথার মানুষটি নবটা ঘুরিয়ে সিগনাল আরও বাড়িয়ে দিল। শারমিন সাথে সাথে থরথর করে কেঁপে ওঠে, আতঙ্কে ভয়াবহ একটা চিৎকার করতে গিয়ে সে থেমে গেল। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বোঝাল, মিথ্যা! মিথ্যা! সব মিথ্যা। ওরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, আসলে ভয়ের কিছু নেই। আমি ভয় পাব না, কিছুতেই ভয় পাব না। কিছুতেই না। কিছুতেই না!
শারমিন প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত করে, পুরো ভয়টুকু জোর করে নিজের মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সে চোখ বন্ধ করে অন্য কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করে, বিড়বিড় করে বলে, আমি ভয় পাব না। কিছুতেই ভয় পাব না। এই মানুষগুলো আমাকে যন্ত্র দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আসলে ভয়ের কিছু নেই। আমি সুন্দর জিনিস চিন্তা করব, যেন ভয় না করে। আমি আমার মায়ের কথা চিন্তা করব। ছোট ভাইটার কথা চিন্তা করব, সে কেমন ফোকলা দাঁতে হাসে, সেই কথাটা চিন্তা করব। শারমিন তার চোখের সামনে তার সব প্রিয় দৃশ্যগুলো নিয়ে আসে, নীল আকাশে সাদা মেঘ, একটা গাছের ডালে হলুদ রঙের একটা পাখি, বাগানে ফুলের গাছে রঙিন ফুল। পানির ওপর একটা গাছের ডাল, সেখানে একটা রঙিন মাছরাঙা পাখি।
যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষগুলো মাথা চুলকাল। নীল চোখের মানুষটি বলল, একই ব্যাপার হচ্ছে। পুরো সিগনালটা রিফ্লেক্ট করতে শুরু করেছে।
শুধু তা-ই নয়, আমাদের কয়েল নতুন সিগনাল পিক করছে। কোনো আইসলেটর নেই, তাই সরাসরি সিস্টেমে ঢুকে যাচ্ছে। পজিটিভ ফিডব্যাকের মতো। জেনারেটরের ক্ষতি হতে পারে!
নীল চোখের মানুষটির কেমন যেন রোখ চেপে গেল, দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র মুখে বলল, বাড়াও! সিগনাল আরও বাড়াও।
শারমিনের ভেতর আবার ভয়াবহ আতঙ্ক উঁকি দিতে চায়। শারমিন জোর করে সেটাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। মনে মনে নিজেকে বলে, আমি কিছুতেই ভয় পাব না। কিছুতেই না! আমার কাছে যেটা করতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, আমি সেটাই করব! রাফি স্যার আমাকে প্রাইম সংখ্যা শিখিয়েছে। আমি শেষবার যেই প্রাইম সংখ্যা বের করেছিলাম, সেটা ছিল দুই শ একাত্তর অঙ্কের। আমি এখন পরেরটা বের করব। আমি আমার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে দেব এখানে, তাহলে কোনো কিছু আমার মাথায় ঢুকতে পারবে না। কেউ আমার মনোযোগ নষ্ট করতে পারবে না। কেউ না!
শারমিন তার মাথায় একটার পর একটা সংখ্যা সাজাতে থাকে। ধীরে ধীরে তার চারদিকে যেন সংখ্যার একটা দেয়াল উঠতে থাকে। সেই দেয়াল ভেদ করে কোনো কিছু শারমিনের কাছে পৌঁছাতে পারে না। শারমিন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দেয়। তার মুখে প্রশান্তির একটা হাসি ফুটে ওঠে।
নীল চোখের মানুষটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শারমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, যে সিগনালে একজন মানুষের ভয়াবহ অমানুষিক আতঙ্কে চিরদিনের জন্য উন্মাদ হয়ে যাওয়ার কথা, সেই সিগনালে এই মেয়েটি পরম প্রশান্তিতে শুয়ে আছে—তার মুখে বিচিত্র একটা হাসি। মানুষটির কেমন যেন রোখ চেপে যায়, সে নবটিকে স্পর্শ করল।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা বলল, আর বাড়িও না। আমাদের যন্ত্র আর সহ্য করতে পারবে না।
না পারলে, নাই। নীল চোখের মানুষটি হিংস্র মুখে বলল, আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
সে নবটি পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেয়। শারমিন সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে বলল, না! না! না!
ঠিক তখন পুরো ঘরে একটা বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ঝলসে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পুরো এনডেভার কেঁপে ওঠে। ঘরটি সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে যায়, যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে ছিটকে পড়তে থাকে। প্রথম বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আরেকটা বিস্ফোরণ হলো, সেটি হলো আগের চেয়েও জোরে। পুরো এনডেভারের ভবন থরথর করে কেঁপে ওঠে রাফি টের পেল যে মানুষটি তাকে ধরে রেখেছিল, সে ছিটকে পড়েছে। তাকে ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে।
রাফি দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, ঠিক তখন আরও ভয়ংকর দুটো বিস্ফোরণ হলো। কোথায় জানি আগুন লেগেছে, আগুনের শিখায় ঘরের ভেতর আবছা দেখা যাচ্ছে।
রাফি দেখল, ঘরের কোনায় চেয়ারে বসে আছে শারমিন, ঈশিতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। রাফি টলতে টলতে সেদিকে এগিয়ে যায়। দুজনকে ধরে বলল, ভয় পেয়ো না তোমরা, ভয় পেয়ো না।
ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, কিসের বিস্ফোরণ?
মাজু বাঙালি। সে রেডি করে দিয়েছে, শারমিন শুরু করিয়ে দিয়েছে—
রাফি কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই পরপর আরও দুটো বিস্ফোরণ হলো, তার প্রচণ্ড ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ল। চারদিকে আগুন লেগেছে। অনেক মানুষ ছোটাছুটি করছে, তাদের আতঙ্কিত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। অনেক দূর থেকে সাইরেনের শব্দ ভেসে আসতে থাকে।
রাফি উঠে বসার চেষ্টা করল, চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। তার মাঝে দেখতে পেল দূর থেকে দুলতে দুলতে অনেক দূর থেকে অনেকগুলো টর্চলাইটের আলো ছুটে আসছে। তার মানে, অনেক মানুষ ছুটে আসছে। কে মানুষগুলো?
টর্চলাইটের আলো ঘরের সামনে এসে থেমে যায়। হঠাৎ করে সে শুনতে পেল, কেউ একজন ডাকছে, ঈশিতা! রাফি! শারমিন! তোমরা কোথায়?
রাফি গলার স্বর চিনতে পারে। মাজু বাঙালি। আর তাদের ভয় নেই।
মাজু বাঙালি আবার ডাকল, রাফি! ঈশিতা।
রাফি ভাঙা গলায় বলল, আমরা এখানে।
রাফি দেখতে পায়, অনেকগুলো টর্চলাইটের আলো তাদের দিকে ছুটে আসছে। পেছনের মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু রাফি জানে, না দেখতে পেলেও ক্ষতি নেই। এরা সবাই তার আপনজন। এরা তাদের বাঁচাতে ছুটে আসছে।
১২. এনডেভারের হাসপাতাল
শারমিন এনডেভারের হাসপাতালের সবুজ রঙের একটা গাউন পরে শীতে তিরতির করে কাঁপছিল, সে দুটি হাত তার বুকের কাছে ধরে রেখেছে। চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কম বয়সী তরুণ-তরুণী। সুহানা নেটওয়ার্কিং ল্যাবের কম্পিউটারের লগ দেখে পুরো ব্যাপারটা আন্দাজ করে ফেসবুকে, টুইটারে খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছিল। এনডেভারের ভেতর ঈশিতা, রাফি আর শারমিনকে আটকে রাখা হয়েছে, আর শারমিন হচ্ছে সম্ভাব্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ—এ তথ্যটি জানাজানি হওয়ার পর হাজার হাজার কম বয়সী ছেলেমেয়ে এনডেভারের সামনে ভিড় করেছে। পুলিশ সেই ভিড়ের কাছ থেকে রক্ষা করে ঈশিতা, রাফি আর শারমিনকে একটা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝখানে অনেকগুলো টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান তাদের থামাল। একজন জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটিই কি সেই প্রতিভাবান মেয়ে শারমিন?