হ্যাঁ, আছে।
অক্সিজেন-নাইট্রোজেনের অনুপাত?
চব্বিশ আর ছিয়াত্তর। মানুষটি হঠাৎ থেমে বলল, কিন্তু—
কিন্তু কী?
খুবই বিচিত্র। আমরা মিথেনের একটা লাইন দেখছি।
কীসের লাইন?
মিথেনের। খুবই কম। কিন্তু নিশ্চিত, মিথেনের লাইন।
কী বলছ তুমি? আমাদের এই স্পেকট্রামে মিথেনের লাইন থাকার অর্থ কী, তুমি জানো?
জানি। এর অর্থ পুরো বিল্ডিং মিথেন দিয়ে বোঝাই, সেখান থেকে লিক করে এখানে ট্রেস অ্যামাউন্ট দেখা যাচ্ছে।
দাড়ি-গোঁফোর জঙ্গল মানুষটি বলল, হ্যাঁ। এটা সম্ভব নয়। এখানে মিথেন আসার কোনো উপায় নেই। নিশ্চয়ই মাস স্পেকট্রোমিটারটা ঠিক করে কাজ করছে না।
নিশ্চয়ই তা-ই। সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ে। শুধু রাফি বুঝতে পারল, কী ঘটেছে। মাজু বাঙালি এসে যন্ত্রপাতির ঘরগুলোয় অক্সিজেন-মিথেন দিয়ে বোঝাই করেছে। এখন দরকার শুধু একটা স্পার্ক। তাহলেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে এনডেভারের একটা অংশ উড়ে যাবে। উত্তেজনায় রাফির বুক ধক ধক করে শব্দ করতে থাকে।
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি কয়েকটা যন্ত্রের সুইচ অন করে দিয়ে বলল, আমরা শুরু করছি।
কোনটা দিয়ে শুরু করবে?
সোজা কিছু দিয়ে শুরু করি। ঘুম।
ঠিক আছে। মানুষটি একটা নব ঘুরিয়ে বলল, নাইনটি থ্রি গিগা।
চমৎকার।
এমপ্লিফুড অপটিমাল।
চমৎকার।
মেয়েটা এখন শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে।
সবাই শারমিনের দিকে তাকাল। শারমিন চোখ বড় বড় করে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে মোটেই ঘুমিয়ে পড়েনি।
শারমিন মানুষগুলোর কথা বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এক-দুটি শব্দ থেকে অনুমান করছিল, তাকে দিয়ে কোনো একটা পরীক্ষা করাবে। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনো পরীক্ষা। পরীক্ষাটি কী, সে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু সে প্রস্তুত হয়ে রইল। হঠাৎ করে তার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে শারমিন বুঝে যায়, পরীক্ষাটি কী। যন্ত্র দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু শারমিন ঘুমাবে না, সে কিছুতেই ঘুমাবে না। শারমিন জোর করে নিজেকে জাগিয়ে রাখল। হঠাৎ ঢেউয়ের মতো করে ঘুম এসে তাকে ভাসিয়ে নিতে চায়, কিন্তু শারমিন তাকে কিছুতেই ভাসিয়ে নিতে দিল না। দাঁতে দাঁত চেপে জেগে রইল। বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, ঘুমাব না। আমি ঘুমাব না। কিছুতেই ঘুমাব না।
শারমিন জোর করে চোখ বড় বড় করে জেগে রইল আর সেটি দেখে নীল চোখের মানুষটি চিন্তিত মুখে বলল, দেখেছ? মেয়েটা ঘুমাচ্ছে না।
হ্যাঁ, আগে কখনো দেখিনি। আমি থ্রি ডিবি বেশি পাওয়ার দিচ্ছি, তার পরও ঘুম পাড়ানো যাচ্ছে না।
আরও থ্রি ডিবি বাড়াও।
একজন নব ঘুরিয়ে শারমিনের মাথায় আরও বেশি পাওয়ার দিতে শুরু করল। শারমিনের চোখ ভেঙে ঘুম আসতে চাইছিল, কিন্তু সে তবু জোর করে জেগে রইল।
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি তার দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমরা ইচ্ছে করলে আরও পাওয়ার বাড়াতে পারি, কিন্তু আমি সেটা করতে চাচ্ছি না।
কেন? মেয়েটার ক্ষতি হবে?
না, সে জন্য নয়। আমাদের কয়েলটা একটা সিগনাল পাঠাচ্ছে, তার মস্তিষ্কের সেটা গ্রহণ করার কথা। মনে হচ্ছে, তার মস্তিষ্ক সেটা গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিচ্ছে—
কী বলছ পাগলের মতো?
আমি পাগলের মতো মোটেই বলছি না। তাকিয়ে দেখো। হেলমেটের ভেতর যে কয়েল আছে, সেটা এই মেয়েটার মস্তিষ্ক থেকে এই সিগনালটা পিক করছে। পজিটিভ ফিডব্যাকের মতো—এটা বেড়ে আমাদের সোর্সে যাচ্ছে। তাপমাত্রা কত বেড়েছে, দেখেছ?
ও মাই গড! যে মানুষটি কম কথা বলে, সে এবার কথা বলল, আমি এটা বিশ্বাস করি না!
সেটা তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আসল সত্যটি হচ্ছে, আমরা মেয়েটার মস্তিষ্ককে বশ করতে পারছি না। উল্টো মেয়েটা আমাদের জেনারেটরকে ওভার লোড করে দিচ্ছে।
চারজন মানুষ কিছুক্ষণ তাদের যন্ত্রপাতির দিকে তাকিয়ে রইল এবং মাথা চুলকাল, তখন একজন বলল, সার্ভারে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ট্রান্সকিনিওয়াল জেনারেটরটা বন্ধ করো।
নীল চোখের মানুষটি বলল, আরও একবার চেষ্টা করে দেখি।
কী চেষ্টা করবে?
এক শ চুয়াল্লিশ গিগা হার্টজ!
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, আতঙ্ক?
হ্যাঁ, আতঙ্ক। ভয়াবহ আতঙ্ক।
মেয়েটার ক্ষতি হবে না তো? মনে নেই, একজন কখনো রিকভার করতে পারল না। পাকাপাকিভাবে স্কিজোফ্রেনিয়া হয়ে গেল?
নীল চোখের মানুষটি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, দেখা যাক।
মানুষগুলো যন্ত্রের নব ঘুরিয়ে সিগনাল পাওয়ার কমিয়ে আনতেই শারমিন হঠাৎ করে যেন জেগে ওঠে। তার ভেতরে যে প্রচণ্ড ঘুমের চাপ ছিল হঠাৎ করে সেটা পুরোপুরি দূর হয়ে গেল। শারমিন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, মানুষগুলো একটু উত্তেজিত হয়ে আবার যন্ত্রপাতির সামনে দাঁড়িয়েছে। সে বুঝতে পারে, তারা এখন আবার কিছু একটা করবে। কী করবে, কে জানে!
হঠাৎ করে শারমিনের কেমন যেন ভয় করতে থাকে। সে বুঝতে পারে না, কেন তার ভয় করছে। শারমিন মাথা ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, কী নিয়ে তার ভয়, সেটা সে বোেঝার চেষ্টা করল।
মানুষগুলো নব ঘুরিয়ে সিগনালটা বাড়িয়ে দিতেই শারমিনের ভয়টুকু ভয়াবহ আতঙ্কে রূপ নেয়, সে চোখ বন্ধ করে একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে।
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি নিজের গাল চুলকে সন্তুষ্টির ভান করে মাথা নেড়ে বলল, এইটা ঠিক ঠিক কাজ করছে। দেখেছ?
নীল চোখের মানুষটি বলল, আগেই এত নিশ্চিত হয়ো না। সিগনাল পাওয়ার আরও কয়েক ডিবি বাড়াও। হৃৎস্পন্দন দ্বিগুণ হতে হবে, সারা শরীর ঘামতে হবে, চিৎকার করে গলায় রক্ত তুলে দেবে, তখন আমি নিশ্চিত হব।