রাফি বুঝতে পারে, এ মানুষটি যা বলছে, তার প্রতিটি কথা সত্যি। সে রিভলবার দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে সত্যি, কিন্তু যখন প্রয়োজন হবে, তখন সে গুলি করতে পারবে না। কিন্তু এটি তো কখনোই তাদের বুঝতে দেওয়া যাবে না। বব লাস্কিকে যে রকম ভয় দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে, এদেরও ঠিক সেভাবে ভয় দেখাতে হবে। রাফি তাই চিৎকার করে হিংস্র মুখে বলল, খবরদার! একটা বাজে কথা বলবে না। যে যেখানে আছ, সে সেখানেই হাত তুলে দাঁড়াও।
নীল চোখের মানুষটি বলল, আমি হাত তুলছি না। দেখি, তুমি আমাকে গুলি করতে পার কি না।
রাফি আবার চিল্কার করে বলল, তোলো হাত। না হলে গুলি করে দেব।
করো গুলি। বলে নীল চোখের মানুষটি এক পা এগিয়ে এসে বলল, করো।
রাফি বুঝতে পারল, সে হেরে যাচ্ছে, মানুষটি তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকবে এবং সে কিছুতেই তাকে গুলি করতে পারবে না।
কিন্তু কিছুতেই সে হেরে যেতে পারবে না। কিছুতেই না। সে হিংস্র গলায় বলল, খবরদার! আর কাছে আসবে না।
নীল চোখের মানুষটি মধুরভাবে হাসল। বলল, এই যে আরও কাছে এসেছি। কী করবে তুমি? গুলি করবে? করো।
রাফি ভাঙা গলায় আবার চিৎকার করতে যাচ্ছিল, তখন নীল চোখের মানুষটি শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, শোনো ছেলে, আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি, তুমি আসলে জীবনে হাতে কখনো কোনো রিভলবার ধরনি। তুমি যেভাবে রিভলবারটা ধরেছ, এভাবে ধরে গুলি করলে গুলি টার্গেটে লাগবে না, ওপর দিয়ে চলে যাবে। দুই হাতে ধরতে হয়, আরেকটু নিচু করে ধরতে হয়। তা ছাড়া রিভলবারে সেফটি ক্যাচ বলে একটা জিনিস থাকে, সেটা ঠিক করে না নিলে গুলি বের হয় না। তুমি ট্রিগার টেনে দেখো, কোনো গুলি বের হবে না।
রাফি ট্রিগার টেনে দেখার চেষ্টা করল না। অবাক হয়ে নীল চোখের মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। নীল চোখের মানুষটি এতক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, সেই চোখে ছিল এক ধরনের উত্তেজনা। হঠাৎ করে সেই চোখ দুটির উত্তেজনাও নিভে যায়, তাকে কেমন জানি বিষণ্ণ দেখায়। মানুষটি ক্লান্ত গলায় বলল, এই ছেলে, তুমি আসলে খুব বড় নির্বোধ। তুমি যখন এই ঘরে ঢুকেছ, ঠিক তখন আমি অ্যালার্মে চাপ দিয়েছি। সিকিউরিটির লোকজন আসছে, যতক্ষণ এসে হাজির না হচ্ছে, আমি ততক্ষণ তোমাকে একটু ব্যস্ত রাখতে চেয়েছিলাম, আর বেশি কিছু নয়। ওরা এসে গেছে।
মানুষটার কথা শেষ হওয়ার আগেই সশব্দে দরজাটা খুলে যায় এবং হুঁড়মুড় করে ভেতরে কয়েকজন মানুষ ঢোকে। তাদের সবার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কিছু বোঝার আগেই তারা রাফিকে জাপটে ধরে ফেলল এবং তাকে নিচে ফেলে দিয়ে তার হাতটা উল্টো দিকে ভাঁজ করে চেপে ধরে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় রাফি চিৎকার করে ওঠে। রাফি শুনতে পেল, বব লাস্কি চিৎকার করে। বলল, মেরে ফেলো! মেরে ফেলো এই দুই আহাম্মককে।
রাফি তার কানের নিচে শীতল একটা ধাতব স্পর্শ অনুভব করল। সাথে সাথে সে একজন অনুভূতিহীন মানুষে পরিণত হয়ে যায়। তার ভেতর ভয় ভীতি, দুঃখ-বেদনা কোনো অনুভূতিই নেই। সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
ঠিক তখন দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, এক সেকেন্ড। মারতেই যদি হয়, ল্যাবের ভেতরে নয়, বাইরে। খুনোখুনি দেখে প্রডিজি মেয়েটার উল্টো প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমাদের এক্সপেরিমেন্টের সমস্যা হবে।
রাফি অনুভব করল, ধাতব শীতল নলটি তার কানের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে। কেউ একজন তাকে টেনে সোজা করে। রাফি বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে ঘরের ভেতর তাকাল। দুজন মানুষ ঈশিতাকে দুই পাশ থেকে ধরে রেখেছে। কাছেই একটা চেয়ারে শারমিন স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা, সে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে আছে, তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝরছে।
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, এ দুজনকে কয়েক মিনিট এখানে রাখো। এরা আমাদের এক্সপেরিমেন্টটা দেখে যাক।
বব লাস্কি বলল, এদের দেখিয়ে কী লাভ?
কোনো লাভ নেই। সবকিছুই মানুষ লাভের জন্য করে, কে বলেছে? তারা যে বাচ্চাটিকে বাঁচানোর জন্য এত ঝামেলা করছে, আমরা সেই বাচ্চাকে দিয়ে কী করতে পারি, তার একটা ধারণা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে ফেরত যাক।
বব লাস্কি বলল, তোমার পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই নাৎসি কনসেনট্রেশন। ক্যাম্পে কাজ করত। মানুষকে অত্যাচার করে তুমি অন্য রকম আনন্দ পাও। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি আনন্দে হা হা করে হেসে বলল, এই যে মাস্টার সাহেব ও সাংবাদিক সাহেব, আমাদের এই যন্ত্রটার নাম ট্রান্সকিনিওয়াল ইন্টারফেস। এটা মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিতে পারে। দেখা গেছে, এটা দিয়ে মানুষের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমরা আমাদের সব টেস্ট করেছি, এখন এই টেস্ট করা বাকি। আমরা এখন এই বাচ্চাটির মাথার নির্দিষ্ট স্থানে খুব হাই ফ্রিকোয়েন্সির ম্যাগনেটিক ফিল্ড দেব। আমরা তার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব এবং সবচেয়ে বড় কথা, তার গাণিতিক ক্ষমতাটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।
রাফি আর ঈশিতা কোনো কথা বলল না। শারমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্যার, ঈশিতা আপু। কী বলছে এ মানুষগুলো?
রাফি কী বলবে বুঝতে পারল না। মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু দিয়ে কী লাভ?
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক আছে?