নীল চোখের মানুষটি খ করে শারমিনের হাত ধরে তাকে হ্যাচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিতে থাকে। শারমিন ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলল, যাব না। আমি যাব না। কেউ তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না। শারমিন কোনোভাবে চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঈশিতার দিকে ছুটে আসে। ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে শারমিনকে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু দুই দিক থেকে তখন দুজন মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ের মতো কালো মানুষটি ঈশিতাকে ধরে বলল, তুমি আর একটু নড়েছ কি তোমার অবস্থা হবে তোমার বন্ধুর মতন।
ঈশিতা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল, পারল না। যে মানুষটি তাকে ধরেছে, তার গায়ের জোর মোষের মতন, আঙুলগুলো লোহার মতো শক্ত। বেশ কয়েকজন মিলে শারমিনকে ধরেছে, সে চিৎকার করে কাঁদছে। সেই অবস্থায় তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঈশিতা শারমিনের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে থাকে। ক্রোধ, ভয়ংকর-ক্রোধ তার ভেতরে পাক খেতে থাকে। অসহায় ক্রোধের মতো যন্ত্রণা বুঝি আর কোথাও নেই। সে বব লাস্কির দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, তোমাকে এর মূল্য দিতে হবে।
বব লাস্কি সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, তুমি ছোট একটা ভুল করেছ, মেয়ে। আমাকে মূল্য দিতে হবে না, আমাকেই মূল্য দেওয়া হবে। এটা দেখার জন্য তুমি থাকবে না, সেটাই হচ্ছে দুঃখ।
রাফির মনে হলো, অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডাকছে, রাফি, এই রাফি ঘুমের মধ্যে তার মনে হলো মানুষটিকে সে চেনে। কিন্তু কে, ঠিক বুঝতে পারছে না। মানুষটি আবার ডাকল, এই রাফি, চোখ খুলে তাকাও—
গলার স্বরটি একটি মেয়ের। রাফি চোখ খুলে তাকাল, ঠিক তার মুখের ওপর ঈশিতা ঝুঁকে আছে, তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, রাফি?
রাফি তখনো পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না, আবছা আবছাভাবে তার সবকিছু মনে পড়তে থাকে এবং হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করল, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। সে মাথায় হাত দিতেই অনুভব করে, সেখানে চটচটে রক্ত। রাফি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়?
একটা ঘরে। কাল রাত আমাকে এই ঘরে আটকে রেখেছিল।
শারমিন?
জানি না। সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেছে।
রাফি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার জন্য এই বাচ্চা মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ হলো।
ঈশিতা বলল, কেন, তোমার জন্য কেন?
আমি যদি বের না করতাম যে শারমিন একটা প্রডিজি, যদি তার ডিসলেক্সিয়ার একটা সমাধান বের করে না দিতাম, তাহলে তো সে এখনো বেঁচে থাকত। তাহলে কেউ তার মাথা কেটে ব্রেন বের করে নিতে পারত না।
সেটি তো তোমার দোষ নয়। এই পৃথিবীতে যে দানবেরা আছে, সেটা
কী তোমার দোষ?
রাফি কোনো কথা বলল না। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?
রাফি বলল, আমাদের শেষ ভরসা মাজু বাঙালি।
মাজু বাঙালি কী করবে?
এই ঘরের ভেতর নিশ্চয়ই তিরিশটা টেলিভিশন ক্যামেরা আমাদের দিকে মুখ করে রেখে দেখছে, আমরা কী করি। আমরা কী বলি। কাজেই আমি এখন। কিছু বলব না।
ঠিক আছে। দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। রাফি হঠাৎ ছটফট করে উঠে বলল, আমি আর পারছি না। কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা অসম্ভব একটা ব্যাপার।
ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, আমি জানি, এর চেয়ে বেশি কষ্ট আর কিছুতে না। কাল সারাটা রাত আমার এভাবে কেটেছে। কিন্তু করবে কী? এটুকুন একটা ঘরে তুমি কী করবে?
রাফি বলল, জানি না। কিন্তু দেখি! সে উঠে দাঁড়াল, সাথে সাথে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা করে ওঠে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথার ধাক্কাটা সহ্য করে। ব্যথাটা একটু কমার পর সে ঘরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। একটা দরজা ছাড়া এখানে ঢোকার কিংবা বের হওয়ার অন্য কোনো পথ নেই। ছোট একটা বাথরুম, সেখানে একটা সিংক আর টয়লেট, আর কিছু নেই। রাফি ওপরে তাকাল, ঘরের ভেতরে আলোগুলো আসছে ফলস সিলিংয়ের ভেতর থেকে। লাইট বাল্ব দেখা যাচ্ছে না—শুধু নরম একটা আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। নিচ্ছিদ্র একটা ঘর, দরজা কিংবা দেয়াল ভেঙে এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
এ রকম সময় দরজায় শব্দ হলো, খুট করে একটা শব্দ হলো এবং খাবারের ট্রে হাতে একজন মানুষ এসে ঢুকল। সকালে যে মানুষটি এসেছিল, এটি সেই মানুষ নয়। অন্য একজন, অন্য মানুষটির মতোই এর ভাবলেশহীন মুখ। ঘরে যে দুজন মানুষ আছে, সেটি যেন সে লক্ষও করছে না। ট্রে দুটি মেঝেতে রেখে সে যন্ত্রের মতো পুরো ঘরটি একবার দেখে, বাথরুমে যায়, অকারণে ট্যাপ খুলে দেখে এবং টয়লেট ফ্লাশ করে তারপর ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
রাফি খাবারগুলো দেখে বলল, এগুলো খেতে হবে? আমাদের কি এখন খাওয়ার মুড আছে?
নেই। কিন্তু তুমি অবাক হয়ে যাবে যে তুমি তার পরও কী পরিমাণ খেতে পারবে। এ রকম অবস্থায় যখন শরীরের কিছু একটা হয়, তখন প্রচণ্ড খিদে পায়।
রাফি অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি তার খিদে পেয়েছে এবং গোগ্রাসে সে সবকিছু খেয়ে শেষ করে ফেলল। নিজেরটা শেষ করে সে ঈশিতার আপেলটা খেতে খেতে গলা নামিয়ে শোনা যায় না, এভাবে ফিসফিস করে বলল, একটু পর লোকটা খালি ট্রে নিতে আসবে না?
হ্যাঁ।
তখন দুজন মিলে লোকটাকে অ্যাটাক করলে কেমন হয়?
ঈশিতা এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলল, চমকার হয়। ওরা এমনিতেই আমাদের মেরে ফেলবে, ভালো মানুষ হয়ে লাভ নেই।