রাফি তার কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে একটা বড় গাড়ি তার ক্যাবে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে ঠিক সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই পাশে আরও একটা গাড়ি থেমে যায়, সেখান থেকে কয়েকজন মানুষ নেমে এসে ক্যাবের দরজা খুলে রাফি আর শারমিনকে হ্যাচকা টান দিয়ে বের করে আনে। তারা কিছু বোঝার আগেই তাদের একটা ফোর হুঁইল ড্রাইভ জিপে তুলে নেওয়া হয় এবং সেটা টায়ারে কর্কশ শব্দ তুলে সামনে এগিয়ে যায়, ব্যস্ত রাস্তায় সেটা ইউ টার্ন নিয়ে উল্টোদিকে ছুটতে থাকে।
রাফি হতবাক হয়ে গাড়ির ভেতর তাকাল, পেছনের সিটে সাফারি কোট পরা দুজন মানুষ বসে আছে। একজনের হাতে একটা বেঢপ রিভলবার, সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার ছাত্ররা আমার নিজের রিভলবারটা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এরা কী রকম ছাত্র, আর্মস ছিনতাই করে?
রাফি কোনো কথা না বলে মানুষটির চেহারা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। মাঝবয়সী নিষ্ঠুর চেহারার মানুষ। মানুষটি হাতের রিভলবারটা শারমিনের মাথায় চুঁইয়ে বলল, চুল ছোট করে কাটলেই মেয়ে কি ছেলে হয়ে যায়?
রাফি কোনো কথা না বলে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটি বলল, এই মেয়েটার মগজ নাকি মিলিয়ন ডলার কেজিতে বিক্রি হবে। ইচ্ছে করছে, গুলি করে খুলি ফুটো করে সেই মগজটা দেখি—মিলিয়ন ডলারের মগজ দেখতে কী রকম!
খুব উঁচুদরের রসিকতা করেছে, সে রকম ভঙ্গি করে মানুষটি হা হা করে। হাসতে থাকে। রসিকতাটা নিশ্চয়ই উঁচুদরের হয়নি, গাড়ির আর কেউ তার। হাসির সঙ্গে যোগ দিল না। মানুষটি সে কারণে একটু মনঃক্ষুন্ন হলো বলে মনে হলো। মুখটা শক্ত করে বলল, শোনো, মাস্টার সাহেব আর তোমার ছাত্রী, এই গাড়ির ভেতরে তোমরা কুঁ শব্দ করবে না। গাড়ির কাচ কালো রঙের, বাইরের কেউ তোমাদের দেখবে না। গাড়ি সাউন্ডপ্রুফ, চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেললেও কেউ শুনতে পারবে না। তার পরও যদি বাড়াবাড়ি করো, আমি দুজনকে অজ্ঞান করে রাখব। অনেক আধুনিক উপায় আছে, আমি সেসবে যাব না, রিভলবারের বাট দিয়ে মাথার পেছনে শক্ত করে। মারব—অনেক পুরোনো পদ্ধতি কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস কাজ করে।
রাফি বুঝতে পারল, মানুষটি তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে না। কাজেই সে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগেই সে ঈশিতার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল, এখন সে নিজে ঠিক ঈশিতার জায়গায় এসে পড়েছে। তার জন্য এখন কে দুশ্চিন্তা করবে? কেউ কি আছে দুশ্চিন্তা করার?
রাফির জন্য কেউই দুশ্চিন্তা করছিল না, সেটি অবশ্য সত্যি নয়। সুহানা যখন রাফির সাথে কথা বলছিল, তখন ঠিক কথার মাঝখানে সে শুনতে পেল। একটা বিকট শব্দ এবং তারপর কিছু উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। হঠাৎ করে টেলিফোনটা নীরব হয়ে গেল—আর কিছু বুঝতে না পারলেও অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে, সেটা বুঝতে সুহানার অসুবিধা হলো না।
সে রাফির ক্লাসে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিল, তারপর সে অন্যদের খোঁজাখুঁজি করল। কাউকে না পেয়ে সে গেল নেটওয়ার্কিং ল্যাবে। রাফি আর শারমিনকে সেদিন এখানে একটা কম্পিউটারে বসে কিছু কাজ করতে দেখেছে—তারা কী কাজ করছিল, সেটা একটু বুঝতে চায়।
প্রফেসর হাসান এলে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, স্যার অনেক মানুষকে চেনেন, পুলিশকে হয়তো খবর দিতে পারবেন। তাদের কথাকে কেউ গুরুত্ব দেবে না, প্রফেসর হাসানকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে।
১০. ঘরটিতে ঢুকে ঈশিতা হতভম্ব
ঘরটিতে ঢুকে ঈশিতা হতভম্ব হয়ে গেল। গতকাল কালো টেবিলটার যে মাথায় সে বসেছিল, আজকে সেখানে বসে আছে রাফি ও শারমিন। শারমিনের চুল ছেলেদের মতো করে কাটা, কিন্তু সে জন্য তাকে চিনতে কোনো সমস্যা হলো না। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না—মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে রাফির সঙ্গে কথা বলেছে। ঈশিতা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, রাফি, তুমি?বই কম।
রাফি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, হ্যাঁ।
কেমন করে?
রাফি কিছু বলার আগে সাফারি কোট পরা চুল ছোট করে ছাঁটা মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, তুমি যখন তার সঙ্গে পিরিতের কথা বলছিলে, তখন তাকে ট্র্যাক করেছি। এ জন্য যখন-তখন পিরিতের কথা বলতে হয় না। মানুষটি হা হা করে আনন্দে হাসতে থাকে। তার কথা বলার অশালীন ভঙ্গিটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঈশিতা রাফির কাছে গিয়ে বলল, তোমাকেও ধরে এনেছে? কী সর্বনাশ!
রাফি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ, খুব ঝামেলার মাঝে পড়ে গেলাম মনে হচ্ছে।
টেবিলের অন্য পাশে বব লাস্কি বসেছিল, সে ইংরেজিতে বলল, বস। কোনো রকম পাগলামি করার চেষ্টা করো না। তার কারণ, তোমাদের পেছনে যে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তারা আর্মড। কিন্তু তাদের আর্মড থাকার প্রয়োজন নেই, তারা খালি হাতেই দু-চারটা মানুষ খুন করতে পারে।
রাফি পেছনে তাকাল, নিঃশব্দে তার পেছনে একজন সাদা এবং একজন কুচকুচে কালো মানুষ কখন এসে দাঁড়িয়েছে, সে লক্ষ করেনি। শারমিন রাফির হাত ধরে ভয় পাওয়া গলায় বলল, এই মানুষটা কী বলছে?
রাফি বলল, আমাদের চুপ করে বসে থাকতে বলেছে।
মানুষটা এখন আমাদের কী করবে?
আমি জানি না। দেখি, কী করে।
বব লাস্কি বলল, তোমাদের সঙ্গে যে বাচ্চাটা বসে আছে, সেই কি অসাধারণ প্রতিভাধর বাচ্চা, যে আমাদের এনক্রিপটেড কোড ভেঙেছে?
রাফি কিংবা ঈশিতা কেউই কথার উত্তর দিল না। বব লাস্কি একটু কঠিন গলায় বলল, আমার কথার উত্তর দাও।