ক্লাসের ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে রাফির দিকে তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল। রাফি বলল, আমি তোমাদের যে কোর্সটা নেব, সেটার নাম ইনট্রোডাকশন টু কোয়ান্টাম মেকানিকস। আমি যখন এই কোর্সটা। প্রথম নিই, তখন যে স্যার এই কোর্সটা আমাদের পড়িয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বুড়ো এবং বদমেজাজি। এখন আমার সন্দেহ হয়, আমার সেই স্যার মনে হয় বিষয়টা কোনো দিন নিজেও বোঝেননি। শুধু কিছু ইকুয়েশন মুখস্থ করে রেখেছিলেন। ক্লাসে এসে বোর্ডে সেগুলো লিখতেন। আমরা সেগুলো খাতায় লিখতাম। ক্লাসে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ ছিল না!
রাফি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পরের সেমিস্টারে যে ম্যাডাম এই কোর্সটা নিলেন, তিনি ছিলেন কম বয়সী এবং হাসিখুশি। তাকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি এত নার্ভাস হয়ে যেতেন যে আমাদের মায়া হতো। তাই আমরা কোনো দিন তাঁকে প্রশ্ন করিনি। সেমিস্টারের শেষে ম্যাডাম দশটা প্রশ্ন বোর্ডে লিখে দিতেন, তার থেকে পরীক্ষায় ছয়টা প্রশ্ন আসত! সে জন্য সবাই সেই ম্যাডামকে খুব ভালোবাসত।
সামনে বসে থাকা দুষ্টু টাইপের মেয়েটি বলল, এ রকম স্যার-ম্যাডামকে আমরাও খুব ভালোবাসি!
তার কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে ওঠে। রাফিও হেসে বলল, আমি জানি, এ রকম স্যার-ম্যাডামকে ছেলেমেয়েরা খুব ভালোবাসে। যা-ই হোক, যেটা বলছিলাম, আমি এই সাবজেক্টটা কোনো ভালো টিচারের কাছে পড়তে পারিনি! কাজেই কীভাবে ভালো করে এই সাবজেক্টটা পড়াতে হয়, আমি জানি না। তবে আমি একটা জিনিস জানি! রাফি একটু থেমে সারা ক্লাসের ওপর চোখ বুলিয়ে বলল, কেউ বলতে পারবে, আমি কী জানি?
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বলতে পারল না। রাফি বলল, কীভাবে এই সাবজেক্টটা পড়ানো উচিত নয়, আমি সেটা জানি!
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আবার হেসে উঠল। রাফি বলল, কাজেই আমি নিজে নিজে যেভাবে এটা শিখেছি, আমি তোমাদের সেভাবে শিখাব। ঠিক আছে?
ক্লাসের সবাই মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক আছে। রাফি সারা ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, তবে এ ব্যাপারে একটা বড় সমস্যা আছে। সমস্যাটা কী, জান?
ছেলেমেয়েরা মাথা নেড়ে জানাল, তারা জানে না। রাফি বলল, আমি মাত্র পাস করে এসেছি। কাজেই আমি কিন্তু খুব বেশি জানার সুযোগ। পাইনি। তোমরাও আর দুই-তিন বছর পর আমার জায়গায় আসবে! আমার নলেজ—রাফি দুই আঙুল দিয়ে ছোট একটা গ্যাপ দেখিয়ে বলল, তোমাদের নলেজ থেকে বড়জোর দুই ইঞ্চি বেশি! কাজেই তোমরা যখন দুই ইঞ্চি শিখে ফেলবে, তখন আমাকেও দুই ইঞ্চি বেশি শিখে আবার তোমাদের ওপর দুই ইঞ্চি যেতে হবে। তার মানে বুঝেছ?
ছেলেমেয়েরা মাথা নাড়ল। বলল, বোঝেনি।
তার মানে, তোমাদের লেখাপড়া করে যতটুকু পরিশ্রম করতে হবে, আমাকেও সব সময় তার সমান না হলেও তার থেকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। সব সময় দুই ইঞ্চি ওপরে থাকতে হবে!
রাফির কথাগুলো ছেলেমেয়েরা বেশ সহজেই গ্রহণ করল বলে মনে হলো। রাফি টেবিলে হেলান দিয়ে বলল, কাজটা ঠিক হলো কি না, বুঝতে পারলাম না।
ছেলেমেয়েরা জানতে চাইল, কোন কাজটা, স্যার?
এই যে আমি বললাম, দুই ইঞ্চির কথা! এর ফল আমার জন্য খুব ডেঞ্জারাস হতে পারে।
কী ডেঞ্জারাস, স্যার?
আমার নাম হয়ে যেতে পারে দুই ইঞ্চি স্যার!
সারা ক্লাস আবার একসঙ্গে হেসে ওঠে। রাফি হাসি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তারপর বলে, আজ যেহেতু প্রথম দিন, আমি তাই কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে কিছু বলব না। শুধু কোয়ান্টাম মেকানিকস যাঁরা বের করেছেন, সেই বিজ্ঞানীদের নিয়ে কয়েকটা গল্প বলি। ঠিক আছে?,
সবাই মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। রাফি তখন আইনস্টাইনের গল্প বলল, নীল ববারের গল্প বলল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাকে লুকিয়ে সরিয়ে নেওয়ার সময় তার বিশাল মস্তিষ্ক নিয়ে কী সমস্যা হয়েছিল, তা বলল, শর্ডিংগারের গল্প বলল, ডিরাকের বিখ্যাত নিগেটিভ মাছের গল্প বলল এবং শেষ করল বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর গল্প দিয়ে। এগুলো তার প্রিয় গল্প, সে বলল আগ্রহ নিয়ে। সব মানুষেরই গল্প নিয়ে কৌতূহল থাকে, তাই পুরো ক্লাস গল্পগুলো শুনল মনোযোগ দিয়ে। যেখানে হাসার কথা, সেখানে তারা হাসল; যেখানে ক্রুদ্ধ হওয়ার কথা, সেখানে তারা ক্রুদ্ধ হলো; আবার যেখানে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার কথা, সেখানে তারা ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বিকেলে রাফি তার অফিস ঘরে যখন কাগজপত্র বের করে গুছিয়ে রাখছিল, তখন দরজা খুলে কবির তার মাথা ঢোকাল। বলল, চলো, চা খেয়ে আসি।
চা?
হ্যাঁ।
কোথায়?
টঙে।
চলো।
অফিস ঘরে তালা মেরে রাফি বের হয়ে আসে। কবির বলল, যখন আমরা ছাত্র ছিলাম, তখন এই টঙে চা খেতাম। মাস্টার হওয়ার পরও অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। এখন আমাদের দেখাদেখি অনেক টিচারই আসে, ছাত্ররা খুবই বিরক্ত হয়।
হওয়ারই কথা!
করিডরের গোড়ায় বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, সবাই তাদের সমবয়সী। রাফি তাদের মধ্যে সুহানা আর রানাকে চিনতে পারল। কবির অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এ হচ্ছে রাফি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে নতুন জয়েন করেছে।
সুহানা রাফির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাফি, আজ তুমি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের কী বলেছ?
কেন, কী হয়েছে?
তারা খুব ইমপ্রেসড।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কীভাবে বুঝলে?
সুহানা হাসল। বলল, আমাকে বলেছে।
কী বলেছে?
ছাত্রীরা বলেছে, তুমি নাকি খুব কিউট!