মানুষটা নাশতার ট্রে-টি মেঝেতে রেখে কোনো কথা না বলে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। বাইরে থেকে দরজায় আবার তালা মেরে দিয়েছে, সে তার শব্দটাও ভেতরে বসে শুনতে পেল। নাশতার জন্য তাকে যে খাবারগুলো দিয়েছে, সেগুলো খুব চমৎকার করে সাজানো। এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। দুই স্লাইস রুটি, মাখন, জেলি, ডিম পোচ, কলা, আপেল, এক গ্লাস দুধ আর পানির বোতল। ঈশিতা সকালে নাশতা করতে পারে না—অনেক দিন সে শুধু একটা টোস্ট বিস্কুট কিংবা একমুঠো মুড়ি খেয়ে দিন শুরু করে। ঈশিতা ভেবেছিল, সে নাশতা করতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেল, তার বেশ খিদে। পেয়েছে এবং সে বেশ তৃপ্তি করেই নাশতা করল। খাওয়া শেষ তার, চায়ের তৃষ্ণা হলো কিন্তু কথাটি সে কাউকে বলতে পারল না। ছোট আধুনিক একটা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে।
এ রকম সময়ে খুট করে দরজা খুলে গেল, আগের মানুষটি একটা ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ট্রের ওপরে একটা ছোট পট। একটা সুন্দর পোর্সেলিনের কাপ, একটা পিরিচে টি-ব্যাগ, চিনির প্যাকেট এবং একটা দুধদানিতে দুধ। মানুষটি ট্রে-টি মেঝেতে রেখে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তার গলা থেকে একটা ব্যাগ ঝুলছে, ব্যাগটা মেঝেতে রেখে সে বাথরুমে ঢুকে যায় এবং অনেক রকম শব্দ করে বাথরুম ধোয়া শুরু করে দেয়।
একটু পর বাথরুম থেকে বের হয়ে তার নাশতার ট্রে-টি নিয়ে কোমর থেকে ঝোলানো চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ঈশিতা আবার শুনতে পেল, বাইরে থেকে তালা দেওয়া হয়েছে। ঈশিতা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল এবং হঠাৎ করে লক্ষ করল, মানুষটি তার ব্যাগটা ভুল করে ফেলে গেছে। সে ব্যাগটা টেনে এনে খোলে, ভেতরে একটা সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, কিছু কাগজপত্র, খুচরা টাকা এবং একটা সস্তা মোবাইল টেলিফোন। ঈশিতা কাঁপা হাতে মোবাইল টেলিফোনটা নেয়, বাইরে কাউকে ফোন করার এ রকম একটা সুযোগ পেয়ে যাবে, সে কল্পনাও করতে পারেনি। কাকে ফোন করতে পারে? তার পত্রিকার সম্পাদক নুরুল ইসলামকে, নাকি তার হোস্টেলের রুমমেটকে? নাকি রাফিকে? কিংবা মাজু বাঙালিকে? ঈশিতা আবিষ্কার করল যে কারও টেলিফোন নম্বরই তার মুখস্থ নেই। রাফিকে নানা টেলিফোন থেকে অনেকবার ফোন করেছে বলে আবছা আবছাভাবে তার নম্বরটা একটু বেশি মনে আছে। ঈশিতা কাঁপা হাতে নম্বরটা ডায়াল করল।
ঠিক সেই সময় রাফি মাজহারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শারমিনের হাত ধরে বের হয়ে এসেছে। বাইরে ঢাকা শহরের অবাস্তব ভিড়। মানুষজন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে, তাদের ব্যস্ত ছোটাছুটি দেখে মনে হচ্ছে তারা কেউ বুঝি মানুষ নয়, সবাই যেন একটা খাঁচায় আটকে থাকা ইঁদুরের। বাচ্চা। মনে হচ্ছে, হঠাৎ বুঝি কেউ খাঁচাটা খুলে দিয়েছে এবং ইঁদুরের বাচ্চাগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। রাফি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে একটা হলুদ রঙের ক্যাবকে থামাতে পারল। ক্যাবের ভেতর উঠে রাফি আর শারমিন মাত্র বসেছে, ঠিক তখন তার টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনে অপরিচিত একটা নম্বর।
রাফি টেলিফোনটা ধরে বলল, হ্যালো।
সে শুনল অপর পাশ থেকে ঈশিতা বলছে, রাফি, আমি ঈশিতা।
রাফি সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসে, ঈশিতা? তুমি? কোথায়?
আমি এনডেভারের ভেতর। আমাকে ধরে ফেলেছে।
ধরে ফেলেছে?
হ্যাঁ, আমি খুব বিপদের মাঝে আছি।
তুমি তাহলে টেলিফোনে কীভাবে কথা বলছ?
ঈশিতা বলল, একজন মানুষ ভুল করে তার ব্যাগটা আমার ঘরে ফেলে গেছে। ভেতরে এই টেলিফোনটা ছিল। মানুষটি কখন টের পেয়ে যাবে, জানি। টের পেলেই ফোনটা নিয়ে নেবে। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকটা কথা বলি।
ঈশিতা তাড়াতাড়ি কথা বলতে থাকে, যদিও সে জানত না যে তার তাড়াতাড়ি কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ব্যাগটা মোটেও ভুল করে ফেলে যাওয়া হয়নি, ইচ্ছে করে রেখে যাওয়া হয়েছে। সস্তা টেলিফোনটা আসলে মোটেও সস্তা টেলিফোন নয়, এটি সরাসরি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে aঈশিতা যখন রাফির সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সেই কথা বলার সিগনালটা ট্র্যাক করে রাফিকে খুঁজে বের করা হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাফির ইয়েলো ক্যাবটাকে ট্র্যাক করা হলো এবং তখন একাধিক স্যাটেলাইট থেকে সেটাকে চোখে চোখে রাখা শুরু হয়ে গেল। শহরের বিভিন্ন জায়গায় রাখা এনডেভারের সিকিউরিটি গাড়িগুলোকে সেই খবর পৌঁছে দেওয়া হলো এবং তারা রাফির ইয়েলো ক্যাবটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল।
ঈশিতার সঙ্গে কথা বলে রাফি যখন টেলিফোনটা রেখেছে, তখন আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল, রাফি দেখল, সুহানা ফোন করেছে। সে ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, হ্যালো, সুহানা।
সুহানা অন্য পাশ থেকে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল, কী হলো, রাফি? তুমি কোথায়? নয়টার সময় তোমার ক্লাস, এখন বাজে নয়টা পনেরো। তোমার ছাত্রছাত্রীরা পাগলের মতো তোমাকে খুঁজছে। বিশেষ করে তোমার ছাত্রীরা। তোমাকে পনেরো মিনিট দেখতে পায়নি, তাতেই তাদের হার্ট বিট মিস হতে শুরু করেছে।
রাফি বলল, সুহানা। শোনো। আমি অসম্ভব বড় একটা ঝামেলার মাঝে পড়েছি।
সুহানা সাথে সাথে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কী হয়েছে, রাফি?
আমি এখন ঢাকায়। একটা ইয়েলো ক্যাবে থানাতে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আছে শারমিন। থানাওয়ালারা আমার কথা শুনবে কি না, আমি বুঝতে পারছি না—