মাজহার ভালো করে শারমিনের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, তুমিই তাহলে সেই মেয়ে?
শারমিন কোনো কথা না বলে একটু মাথা নাড়ল। মাজহার বলল, তোমাকে দেখে খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে। তুমি বাথরুমে একটু হাত-মুখ ধুয়ে ওই সোফায় কয়েক মিনিট শুয়ে নাও। আমি রাফি সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলে একসঙ্গে নাশতা করব।
শারমিন আবার মাথা নেড়ে ভেতরে গেল। মাজহার রাফির দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। সে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না, ঈশিতা মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে কি না।
রাফি কিছু বলল না, কী বলবে বুঝতে পারছিল না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি যদি তাকে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা না করে দিতাম, তাহলে এই সর্বনাশ হতো না।
মাজহার বলল, হতো। অন্য কোনোভাবে হতো। মেয়েটাকে আমি খুব কম সময়ের জন্য দেখেছি, কিন্তু যেটুকু দেখেছি, তাতেই বুঝতে পেরেছি, এর জীবনটাই হচ্ছে বিপজ্জনক। আপনি নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। আমি লিখে দিতে পারি, সে নিজেই ভেতরে ঢুকতে চেয়েছে, আপনি তাকে নিষেধ করেছেন।
সেটা সত্যি।
দুজনে সোফায় গিয়ে বসে এবং কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কী বলবে, সেটা যেন ঠিক করে উঠতে পারছে না মাজহার হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, আমি পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখেছি। আপনার সঙ্গে একটু শেয়ার করি। ঈশিতা ইজ রাইট—এনডেভার শুধু যে এ দেশে এফটি টোয়েন্টি সিক্স ভাইরাস ছড়িয়েছে তা নয়, তারা চিকিৎসার নাম করে অসুস্থ মানুষগুলোর ব্রেন নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছে। আমরা সেটা জানি কিন্তু সেটা নিয়ে থানা পুলিশ করতে পারছি না। আপনি তাদের সিস্টেমে ঢুকেছেন, নিজের চোখে দেখেছেন কিন্তু সেই কথাটা কাউকে বলা যাচ্ছে না, কারণ আপনি ঢুকেছেন বেআইনিভাবে। আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, উল্টো আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। শারমিন বিপদে পড়ে যাবে। তা ছাড়া এ দেশে এনডেভারের অনেক সুনাম, মিডিয়া এনডেভারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাদের সম্পর্কে একটা খারাপ কথা কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। এনডেভার ভয়ংকর অন্যায় করতে পারে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা ছোটখাটো বেআইনি কাজও করতে পারব না।
মাজহার রাফির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, রাফি কী ভাবছে। রাফি বলল, আমরা যেটা করেছি, তাদের পাসওয়ার্ড ভেঙে সিস্টেমে ঢুকেছি, সেটা বেআইনি হতে পারে, কিন্তু পুরো বিষয়টা সবাই জানতে পারলে সেটাকে কেউ অনৈতিক বলবে না। পৃথিবীতে অনেকবার এ রকম হয়েছে, কোনো একজন সাংবাদিক একটা অনেক বড় অন্যায়-অবিচার প্রকাশ করে দিয়েছে। সে জন্য জেলও খেটেছে, কিন্তু সারা জীবন মাথা উঁচু করে থেকেছে।
কিন্তু আমাদের সময় খুব কম। ঈশিতাকে এর মাঝে মেরে ফেলেছে কি, আমি জানি না। যদি মেরে ফেলে না থাকে তাহলে যেভাবে হোক ভেতরে পুলিশ-র্যাব-সাংবাদিক পাঠাতে হবে।
কীভাবে পাঠাবেন?
আমি ওদের বিল্ডিংয়ে বিশাল একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে চাই।
বিস্ফোরণ? বিল্ডিংয়ে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
ওদের বিল্ডিংয়ের অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব আমার। আজকে ওখানে সাপ্লাই নিয়ে যাব। ওদের যে রুমে কোনো মানুষ থাকে না, শুধু যন্ত্রপাতি, সেসব রুমে আমি অক্সিজেন লিক করিয়ে দেব।
রাফি মাজহারকে বাধা দিয়ে বলল,কিন্তু অক্সিজেন দিয়ে তো বিস্ফোরণ হয় না। সেটা জ্বলতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু বিস্ফোরণের জন্য এক্সপ্লোসিভ কিছু দরকার—
মাজহার মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, সে জন্য আমি অক্সিজেন লেখা সিলিন্ডারে করে মিথেনও নিয়ে যাব। ঘরের ভেতরে একেবারে সঠিক অনুপাতে মিথেন অক্সিজেন লিক করিয়ে দেব।
তার পরেও তো একটা স্পার্ক দরকার—
আমি যেসব ঘরে লিক করাব, সেখানে ভারী ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, বন্ধ হচ্ছে, চালু হচ্ছে, সেখানে স্পার্ক কোনো ব্যাপার নয়। আমি যেহেতু অক্সিজেন সাপ্লাই নিয়ে কাজ করি, আমাকে সবার আগে শেখানো হয়েছে নিরাপত্তা। সেফটি। আমি নিরাপত্তার যা যা শিখেছি, তার সব কটি আজকে ভায়োলেট করাব।
রাফি মাথা নাড়ল, আপনি মনে হচ্ছে পুরোটা চিন্তা করে দেখেছেন।
হ্যাঁ, করেছি। কিন্তু আমার মনে হলো, আরও একজনের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা একটু শেয়ার করা দরকার। সে জন্য আপনাকে ডেকেছি।
থ্যাংকু।
আপনার যদি কোনো আইডিয়া থাকে, বলেন।
রাফি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, না, এই মুহূর্তে আমার কোনো আইডিয়া নেই। শুধু একটি ব্যাপার–
কী?
আমরা সব সময়ই বলছি, এনডেভার এ দেশের পুলিশ-র্যাব—সবাইকে কিনে রেখেছে। কিন্তু এটা তো হতে পারে না যে এখানে কোনো ভালো মানুষ, সৎ মানুষ নেই। যাকে কেনা সম্ভব না।
নিশ্চয়ই আছে। সব জায়গায় থাকে। সেই জন্যই দেশটি চলছে।
কাজেই আমাদের চেষ্টা করা উচিত। আমি তাই ভাবছি, আমি শারমিনকে নিয়ে যাব। চেষ্টা করব, একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে দেখা করার জন্য। যদি দেখা করতে পারি, তাহলে চেষ্টা করব তাকে বোঝাতে। যদি বোঝাতে না-ও পারি, তাহলে অন্তত একটা জিডি করিয়ে আসব।
গুড আইডিয়া। মাজহার মাথা নাড়ল।
আপনার এখান থেকে বের হয়েই আমি থানায় চলে যাব।
ঠিক আছে। মাজহার বলল, এখন আপনি বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসেন। নাশতা করি।
রাফি আর শারমিন যখন মাজহারের বাসায় নাশতা করছিল, ঠিক তখন ঈশিতার ছোট ঘরটি খুলে একজন মানুষ তার জন্য নাশতা নিয়ে আসে। তাকে সারা রাত যে ঘরে আটকে রেখেছে, সেই ঘরটি ছোট এবং আধুনিক, সঙ্গে খুব ছোট এবং অসম্ভব পরিষ্কার একটি বাথরুমও আছে কিন্তু আর কিছু নেই। সে ঘরের কোনায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় রাত কাটিয়েছে।