নেমে কী করছে?
আমি দূর থেকে দেখলাম, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে টংগুলোর দিকে যাচ্ছে।
সর্বনাশ। সমীর বলল, হ্যাঁ, সর্বনাশ। বদমাইশ দুটো কেন এসেছে বলে মনে হয়?
যেহেতু টংগুলোর দিকে এগোচ্ছে, তার মানে, নিশ্চয়ই শারমিনের খোঁজে যাচ্ছে।
কেন? শারমিনের খোঁজে কেন? শারমিন কী করেছে?
রাফি বলল, এখনো বুঝতে পারছি না। দেখি, কী করা যায়।
রাফি ফোন শেষ করে ঘর থেকে বের হলো। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ঠেলে সে টংয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
শারমিনের বাবা রাফিকে দেখে এগিয়ে এল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আসেন, স্যার। বসেন।
শারমিন কোথায়?
ঢাকা থেকে দুজন স্যার আসছেন। তাঁরা শারমিনের সঙ্গে একটু কথা বলতে নিয়ে গেছেন।
রাফি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায় নিয়ে গেছে?
এই তো এখানে কোনো এক জায়গায়। মনে হয় ক্যানটিনে।
রাফি ছটফট করে বলল, আপনি আপনার মেয়েকে দুজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ছেড়ে দিলেন?
রাফির অস্থিরতাটুকু শারমিনের বাবার ভেতরে সঞ্চারিত হলো। মানুষটি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন, স্যার? কোনো সমস্যা? দেখলাম, বয়স্ক ভদ্রলোক মানুষ। আমার সঙ্গে খুব ভদ্রলোকের মতো কথা বলল-
রাফি বাধা দিয়ে বলল, শারমিন? শারমিন যেতে চাইল?
না। যেতে চাচ্ছিল না। বলছিল, আগে আপনার সঙ্গে কথা বলবে। তখন ভদ্রলোেক দুজন বলল, ঠিক আছে। আপনার কাছেও নিয়ে যাবে। তখন—
রাফি কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না, দূরে তাকিয়ে দেখল, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের কাছে একটা সাদা পাজেরো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয়, ওটাতে করেই এসেছে। যদি কোনোভাবে শারমিনকে টেনে তুলে ফেলে, তাহলেই আর তাকে খুঁজে পাবে না। মানুষগুলোর যে রকম বর্ণনা শুনেছে, তাতে সে নিশ্চিত, তাদের কাছে অস্ত্র আছে, বাধা দিলে গুলি করে বের হয়ে যাবে। রাফি অনুভব করে, তার পিঠ দিয়ে একটা শীতল ঘাম বইতে শুরু করেছে। ঠিক তখন তার ভোটকা হান্নানের কথা মনে পড়ল, সম্ভবত সে-ই এখন তাকে রক্ষা করতে পারবে।
রাফি ফোন বের করে ভোটকা হান্নানের নম্বরে ডায়াল করল। একটা আধুনিক ইংরেজি গান শোনা গেল এবং হঠাৎ করে গানটি থেমে গিয়ে ভোটকা হান্নানের গলার স্বর শোনা গেল, আস্সালামু আলাইকুম, স্যার।
হান্নান, তুমি কোথায়?
মুক্তিযুদ্ধ চত্বরে। কেন, স্যার?
কী করছ?
সংগঠনের একটা ছোট বিষয় নিয়ে একটা ঝামেলা–
রাফি কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি একটু সাহায্য করতে পারবে? খুব জরুরি—
পারব, স্যার। কী করতে হবে, বলেন।
রাফি বলল, না শুনেই বলে দিলে পারবে?
আপনি তো আর আমাকে এমন কিছু বললেন না, যেটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। করা সম্ভব হলে কেন পারব না? কী করতে হবে, বলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যটার কাছে একটা সাদা পাজেরো আছে, দেখেছ?
দেখেছি, স্যার।
ওই পাজেরোয় করে দুজন মানুষ এসেছে শারমিনকে তুলে নিতে। তোমরা শারমিনকে বাঁচাও।
মানুষ দুজন কে?
জানি না। অসম্ভব ক্ষমতাশালী। আর্মড। যেকোনো মানুষকে খুন করার পারমিশন আছে।
মানুষগুলো কই?
শারমিনকে নিয়ে বের হয়েছে। ক্যাম্পাসে কোথাও আছে। মনে হয় ক্যানটিনের দিকে গিয়েছে।
ঠিক আছে, স্যার। আমরা ব্যবস্থা করছি। শারমিনকে আপনার কাছে দিয়ে যাব?
হ্যাঁ, দিয়ে যেতে পারো। আর শোনো, মানুষগুলো কিন্তু আর্মড এবং অসম্ভব ডেঞ্জারাস।
আপনি চিন্তা করবেন না।
টেলিফোন লাইনটা কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাফি দূর থেকে একটা স্লোগান শুনল, জ্বালো জ্বালো—আগুন জ্বালো!
দেখতে দেখতে একটা ছোট জঙ্গি মিছিল বের হয়ে গেল। মিছিলের সামনে শুকনো লিকলিকে হান্নান, পেছন ফিরে গলা উঁচিয়ে স্লোগান ধরছে, অন্যেরা তার উত্তর দিচ্ছে। দূর থেকে সব স্লোগান শোনা যাচ্ছে না, অ্যাকশান অ্যাকশান, ডাইরেক্ট অ্যাকশান এবং প্রশাসনের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে এই দুটি স্লোগান সে বুঝতে পারল। মিছিলটা খুব বড় নয়। মুক্তিযুদ্ধ চত্বরের আশপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে, কখনোই সাদা পাজেরো থেকে বেশি দূরে সরে যাচ্ছে না।
রাফি দূর থেকে লক্ষ করে, হঠাৎ মিছিলটি মুক্তিযুদ্ধ চত্বর থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠে আসে, কারণটাও সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। রাস্তা ধরে সাফারি কোট পরা দুজন মানুষ হেঁটে আসছে; একজন শারমিনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, শারমিনের চোখে-মুখে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক। মানুষ দুজন শারমিনকে নিয়ে রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মিছিলটিকে চলে যাওয়ার জন্য জায়গা দিল। মিছিলটি কিন্তু চলে না গিয়ে একেবারে হুঁড়মুড় করে মানুষ দুজনের ওপর গিয়ে পড়ল। একটা জটলা, জটলার মাঝে হুঁটোপুটি হচ্ছে, চিৎকার-হইচই-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। রাফির মনে হলো, ভেতরে মারপিট শুরু হয়েছে। সে একটু এগিয়ে যাবে কি না ভাবছিল, ঠিক তখন দেখল ভিড়ের মাঝখান থেকে ভোটকা হান্নান শারমিনের হাত ধরে বের হয়ে তাকে নিয়ে ছুটছে।
যেভাবে মারামারি শুরু হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই সেটা শেষ হয়ে গেল। ছাত্রদের দলটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর রাফি মানুষ দুটিকে দেখতে পায়, শার্টের বোতাম ছেড়া, বিধ্বস্ত চেহারা। একজন মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বারবার তার বগলে, পেটের কাছে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। তার কিছু একটা হারিয়ে গেছে।
রাফি অফিসে এসে দেখল, ভোটকা হান্নান একটা চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। কাছাকাছি আরেকটা চেয়ারে শারমিন মুখ কালো করে বসে আছে। রাফিকে দেখে হান্নান উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, তার মুখে এগাল-ওগাল জোড়া হাসি। হাসিকে আরও বিস্তৃত হতে দিয়ে বলল, স্যার, আপনার শারমিনকে নিয়ে এসেছি।