রানা বলল, একেকটা ইউনিভার্সিটির একেক রকম কালচার। আমাদের ইউনিভার্সিটি তো নতুন, তাই এখনো এ রকম আছে, দেখতে দেখতে ইগো প্রবলেম শুরু হয়ে যাবে। যাই হোক, তুমি কোথায় উঠেছ?,
গেস্ট হাউসে।
কোথায় থাকবে, কী করবে, কিছু ঠিক করেছ?
না। এখনো ঠিক করিনি। আপনাদের একটু হেল্প নিতে হবে।
নো প্রবলেম।
কবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল। বলল, আমার একটা ক্লাস আছে। রানা, তুই রাফিকে তার অফিসটা দেখিয়ে দিস।
সুহানা বলল, অফিসটা খালি দেখিয়ে দিলেই হলে নাকি? সোহেল অফিসটা কীভাবে রেখে গেছে, জানিস? আমাকে যেতে হবে।
কবির হা হা করে হাসল। বলল, ঠিকই বলেছিস। ভুলেই গেছিলাম যে সোহেলটা একটা আস্ত খবিশ ছিল!
রানা বলল, ওই অফিসে আধখাওয়া পিজা থেকে শুরু করে মড়া ইন্দুর—সবকিছু পাওয়া যাবে!
সুহানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি অফিস থেকে চাবি নিয়ে আসি।
রানা বলল, আমি দেখি, গৌতমকে পাই নাকি। ঘরটা একটু পরিষ্কার করতে হবে।
কবির ক্লাস নিতে গেল, সুহানা গেল অফিসের চাবি আনতে আর রানা বের হয়ে গেল গৌতম নামের মানুষটিকে খুঁজে বের করতে, সম্ভবত এই বিল্ডিংয়ের ঝাড়ুদার। রাফি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটু দূরে এক সারি কৃষ্ণচূড়াগাছ, গাছের নিচে অনেকগুলো টংঘর, সেখানে ছেলেমেয়েরা আড্ডা মারছে, চা খাচ্ছে। রাফি অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ব্যাপার আবিষ্কার করল। সে যে ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে, সেখানে সবাই অন্য রকম—কাউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রথমেই সে চেষ্টা করবে, কোনো একটা অজুহাত দিয়ে সেটা থেকে বের হয়ে আসতে। সবার ভেতর যে হাবাগোবা, শেষ পর্যন্ত তার ঘাড়ে সেই দায়িত্বটা পড়ে এবং খুবই বিরস মুখে সে সেই কাজটা করে। কোথাও কোনো আনন্দ নেই। এখানে অন্য রকম। কবির রানাকে বলল অফিসটা দেখিয়ে দিতে। সুহানা নিজে থেকে বলল তাকেও যেতে হবে। রানা তখন গেল ঝাড়ুদার খুঁজতে। খুবই ছোট ছোট কাজ কিন্তু এই ছোট ছোট কাজগুলো দিয়েই মনে হয় মানুষের জীবনটা অন্য রকম হয়ে যায়।
মহাজন পট্টিতে সোহেল নামের খবিশ ধরনের ছেলেটির অফিসটিকে যত নোংরা হিসেবে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, সেটি মোটেও তত নোংরা নয়। টেবিলে এবং ফ্লোরে অনেক কাগজ ছড়ানো। ড্রয়ারে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে ময়লা একটা দুই টাকার নোট এবং নাদুসনুদুস একটি মেয়ের সঙ্গে সোহেলের একটা ছবি ছিল। সেটা নিয়েই সুহানা এবং রানা নানা ধরনের টিপ্পনী কাটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরটি পরিষ্কার হয়ে গেল এবং গৌতম নামের মানুষটি ঝাড়ু দিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করে নেওয়ার পর সেটি রীতিমতো তকতকে হয়ে ওঠে সুহানা একটি পুরোনো টাওয়েল দিয়ে ডেস্কটি মুছে একটি রিভলভিং চেয়ার টেনে নিয়ে বলল, নাও, বসো।
রাফি বসতে বসতে বলল, আমাকে কী ক্লাস নিতে হবে, জানেন?
কোয়ান্টাম মেকানিকস!
সর্বনাশ!
সর্বনাশের কিছু নেই, ইনট্রোডাক্টরি ক্লাস। এই ব্যাচের পোলাপানগুলো ভালো। আগ্রহ আছে।
ক্লাসের রুটিন কোথায় পাব, বলতে পারবেন?
সুহানা বলল, আমাদের সঙ্গে আপনি আপনি করার দরকার নেই, আমরা একই ব্যাচের!
থ্যাংক ইউ। ক্লাসের রুটিন কোথায় পাব, বলতে পারবে?
অফিসে আছে, জাহানারা আপু এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার জন্য সবকিছু রেডি করে ফেলেছে। শি ইজ এ সুপার লেডি!
হ্যাঁ। জাহিদ স্যারও বলছিলেন।
রানা বলল, তাহলে চলো, তোমাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিই।
হ্যাঁ। সুহানা হেসে বলল, বাথরুমগুলো কোথায়, কোন টয়লেটের দরজা ভাঙা, মেয়েদের কমনরুম কোথায়!
রানা বলল, তার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবগুলো কোথায়, অন্য টিচাররা কে কোথায় বসে!
এবং কোন কোন টিচার থেকে সাবধানে থাকতে হবে!
রানা অর্থপূর্ণভাবে চোখ টিপে বলল, এবং কেন সাবধানে থাকতে হবে?
ডায়াসের ওপর দাঁড়িয়ে রাফি সামনে বসে থাকা জনাপঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু নার্ভাস অনুভব করে। এই মাত্র প্রফেসর জাহিদ হাসান।
তাকে ক্লাসের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন। প্রথম দিন জয়েন করে দুই ঘণ্টার মধ্যেই তাকে জীবনের প্রথম ক্লাস নিতে হবে, সে বুঝতে পারেনি। প্রফেসর জাহিদ হাসান অবশ্যি তাকে ক্লাস নিতে বলেননি, তার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একটু পরিচিত হতে বলেছেন। রাফি জীবনে কখনো কোনো ক্লাস নেয়নি। কাজেই প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া আর তাদের ক্লাস নেওয়ার মধ্যে তার কাছে খুব বড় কোনো পার্থক্য নেই! সে তার গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, এটা আমার জীবনের প্রথম ক্লাস। আজকের এই ঘটনার কথা তোমরা সবাই ভুলে যাবে কিন্তু আমি কোনো দিন ভুলব না।
দুষ্টু টাইপের একটা মেয়ে বলল, স্যার, এখন আপনার কেমন লাগছে?
সত্যি কথা বলব?
এবার অনেকেই বলল, জি স্যার, বলেন।
আমার খুব নার্ভাস লাগছে।
ক্লাসে ছোট একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। দয়ালু চেহারার একটা ছেলে বলল, নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই, স্যার।
থ্যাংকু। কিন্তু তুমি যদি কোনো দিন স্যার হও, তখন তুমি যদি কোনো দিন ছেলেমেয়েভর্তি ক্লাসে দাঁড়িয়ে লেকচার দেওয়ার চেষ্টা করো, তখন তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবে!
আবার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা শব্দ করে হেসে উঠল। হাসির একটা গুণ আছে, মানুষ খুব সহজেই সহজ হয়ে যায়। রাফিও অনেকটা সহজ হয়ে গেল। বলল, আজ যেহেতু একেবারে প্রথম দিন, তাই আজ ঠিক পড়াব না, কীভাবে পড়াব বরং সেটা নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলি।