ও! বলে তিনজনই তাদের ডেস্ক থেকে বের হয়ে কাছাকাছি চলে আসে। প্রফেসর হাসান পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হচ্ছে কবির, এ হচ্ছে রানা আর এ হচ্ছে সোহানা। এর বাড়ি সিলেট, তাই নিজের নামটাও ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না। বলে সুহানা।
সোহানা নামের মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, স্যার, আমি ঠিকই সোহানা উচ্চারণ করতে পারি। কিন্তু আমার নাম সোহানা না, আমার নামই সুহানা! তা ছাড়া আমার বাড়ি সিলেট না, আমার বাড়ি নেত্রকোনা।
প্রফেসর হাসান হাসলেন। বললেন, আমি জানি। একটু ঠাট্টা করলাম। তারপর রাফির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, এরা তিনজনই আমার ডিরেক্ট স্টুডেন্ট। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার হয়েছে তো, তাই এদের ভেতর হালকা একটু মাস্তানি ভাব আছে, তাই এদের একটু তোয়াজ কোরো, না হলে এরা কিন্তু তোমার জীবন বরবাদ করে দেবে।
কবির নামের ছেলেটি বলল, স্যার, মাত্র এসেছে, আর আপনি আমাদের মাস্তান-টাস্তান কত কিছু বলে দিলেন!
প্রফেসর হাসান হাসলেন, ডন্ট ওরি। রাফি খুব স্মার্ট ছেলে, শুধু শুধু আমি তাকে টিচার হিসেবে নিইনি। সে ঠিকই বুঝে নেবে, আসলেই তোমরা মাস্তান হলে আমি তোমাদের মাস্তান হিসেবে পরিচয় করাতাম না। ঠিক কি না?
রাফি কী বলবে বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়ল। সে টের পেতে শুরু করেছে, তার বুকের ভেতর ভারটা আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। নতুন জায়গায় প্রথমবার কাজ করতে এসে কীভাবে সবকিছু সামলে নেবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, সেই দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে উবে যেতে শুরু করেছে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মধ্যে খুব সহজ একটা সম্পর্ক আছে, সেটা সে বুঝতে শুরু করেছে। এ রকম সময় দরজার পর্দা সরিয়ে আরেকজন মাথা ঢোকাল, কবির নামের ছেলেটি তাকে ডাকল, স্যার আসেন, আমাদের নতুন টিচার জয়েন করেছে।
পর্দা সরিয়ে বিষণ্ণ চেহারার একটা মানুষ ভেতরে এসে ঢোকে। রাফির কাছাকাছি এসে বলে, তুমি তাহলে আমাদের নতুন টিচার? গুড। আইসিটি কনফারেন্সে তুমি নিউরাল কম্পিউটারের ওপর একটা পেপার দিয়েছিলে?
রাফি মাথা নাড়ল। বলল, জি স্যার।
ভালো পেপার, পালিশ-টালিশ করলে ভালো জার্নালে পাবলিশ হয়ে যাবে। কাজটা কে করেছিল? তুমি, না তোমার স্যার?
আইডিয়াটা স্যার দিয়েছিলেন, কাজটা আমার। আর প্রথম যে আইডিয়াটা ছিল, সেখান থেকে অনেক চেঞ্জ হয়েছে।
তা-ই হয়। তা-ই হওয়ার কথা।
প্রফেসর জাহিদ হাসান বললেন, ইনি হচ্ছেন ডক্টর রাশেদ। আমাদের নতুন ইউনিভার্সিটি, সিনিয়র টিচারের খুব অভাব। ষোলোজন টিচারের মধ্যে মাত্র আটজন ডক্টরেট। রাশেদ হচ্ছেন সেই আটজনের একজন।
রাফি বলল, জানি স্যার। যখন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম, তখন সব খোঁজখবর নিয়েছিলাম।
গুড। তাহলে তো ভালো।
রাশেদ জিজ্ঞেস করল, একে কোথায় বসতে দেবেন, স্যার?
তোমরা বলো।
রানা নামের ছেলেটি বলল, মহাজন পট্টিতে সোহেলের রুমটা খালি আছে।
মহাজন পট্টিতে পাঠাবে?
মহাজন পট্টি শুনে রাফির চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার একটু ছায়া পড়ল, সেটা দেখে বিষণ্ণ চেহারার রাশেদ হেসে ফেলল, হাসলেও মানুষটির চেহারা থেকে বিষণ্ণভাব দূর হয় না। হাসতে হাসতে বলল, মহাজন পট্টি শুনে তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনতলায় যে এক্সটেনশন হয়েছে, সেখানে করিডরটা সরু, তাই সবাই নাম দিয়েছে মহাজন পট্টি।
এবার রাফিও একটু হাসল, বলল, ও আচ্ছা। আমাদের হোস্টেলেও একটা উইংয়ের নাম ছিল শাঁখারী পট্টি।
ঠিক এ রকম সময় দরজার পর্দা সরিয়ে জাহানারা উঁকি দেয়, স্যার, আপনাকে ভিসি স্যার খুঁজছেন। ফোনে আছেন।
আসছি। প্রফেসর হাসান কম বয়সী ছেলেমেয়ে তিনজনকে বললেন, তোমরা রাফিকে অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও। ওর অফিসটাও দেখিয়ে দাও। আর রাশেদ, তুমি একটু আসো আমার সঙ্গে।
প্রফেসর হাসান রাশেদকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর কবির, রানা আর সোহানা তাদের ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারগুলো ঘুরিয়ে নিয়ে বসে, রাফির দিকেও একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো রাফি।
রাফি চেয়ারটায় বসে চোখের কোনাটি দিয়ে ঘরটি লক্ষ করল, এই বয়সী চারজন ছেলেমেয়ে এ রকম একটা ঘরে বসলে ঘরটির যে রকম দুরবস্থা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একজনের ডেস্কে একটা ল্যাপটপ, অন্য তিনটিতে এলসিডি মনিটর। পেছনে স্টিলের আলমারি, দেয়ালে খবরের কাগজের ফ্রি ক্যালেন্ডার স্কচটেপ দিয়ে লাগানো।
কবির রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার তোমার কথা বলছিলেন, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে বহুঁ দিন বাইরের কাউকে নেওয়া হয়নি। এবার তোমাকে নেওয়া হলো।
রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি এ রকম হাইফাই ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের ভাঙাচোরা ইউনিভার্সিটিতে চলে এলে, ব্যাপারটা কী? যা রাফি মাথা নাড়ল, আমাদের ইউনিভার্সিটি মোটেও হাইফাই ইউনিভার্সিটি না। আর আপনাদের ইউনিভার্সিটিও মোটেই ভাঙাচোরা ইউনিভার্সিটি না! তা ছাড়া বাইরে আপনাদের ইউনিভার্সিটি, বিশেষ করে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা আলাদা সুনাম আছে।
সুহানা বলল, জাহিদ স্যারের জন্য।
রাফি বলল, জাহিদ স্যারকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
সুহানা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, স্যার খুব সুইট।
স্যার যেভাবে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আর আপনারা যেভাবে স্যারের সঙ্গে কথা বলছেন, আমার ইউনিভার্সিটিতে আমরা সেটা কল্পনাও করতে পারব না। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে গাদা গাদা সব প্রফেসর। কেউ কোনো কাজ করে না, কিন্তু সবার সিরিয়াস ইগো প্রবলেম।