রাফি এবার বইয়ের ভেতর থেকে লাল রঙের একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক বের করে বইয়ের পৃষ্ঠার ওপর রেখে বলল, শারমিন। এখন কী দেখা যাচ্ছে?
শারমিনকে দেখে মনে হলো কেউ তাকে বুঝি ইলেকট্রিক শক দিয়েছে, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস আটকে আসে, সে কাঁপা গলায় বলে, নড়ছে না, এখন আর নড়ছে না! আমি এখন পড়তে পারি! পড়তে পারি!
রাফি বলল, তুমি যে অক্ষরটা দেখছ সেটা হচ্ছে পেটকাটা মূর্ধন্যষ!
এইটা পেট কাটা মূর্ধন্যষ? আমি কতবার শুনেছি এইটার কথা, কতবার দেখার চেষ্টা করেছি, দেখতে পারিনি!
রাফি শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, এখন মনে হয় তুমি দেখতে পারবে, পড়তেও পারবে।
ঈশিতা বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে।
রাফি বলল, একটা অনেক বড় ব্যাপার ঘটেছে—আমরা মনে হয় শারমিনের ডিসলেক্সিয়ার সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি!
কীভাবে? এই লাল প্লাস্টিক দিয়ে?
হ্যাঁ। রাফি মাথা নাড়ল, আমাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট প্রফেসর হাসান এই পদ্ধতিটার কথা বলেছিলেন। অনেক সময় দেখা গেছে, সাদার ওপর কালো লেখাটা হচ্ছে সমস্যা। লাল রঙের ওপর কালো লেখা হলে সমস্যা থাকে না। আমি ঠিক বিশ্বাস করিনি কাজ করবে! তবু ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি। ভাগ্যিস চেষ্টা করেছিলাম, দেখাই যাচ্ছে কাজ করেছে।
শারমিন তখন লাল প্লাষ্টিকটা দিয়ে বইয়ের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা পরীক্ষা করে দেখছে, উত্তেজনায় তার মুখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে সে বুঝি সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, একটু অসতর্ক হলেই হঠাৎ করে আবার বুঝি অক্ষরগুলো জীবন্ত পোকামাকড়ের মতো নড়তে শুরু করবে!
রাফি বলল, শারমিন এখন তুমি পড়তে পারবে।
শারমিন একটা অক্ষর দেখিয়ে বলল, এগুলো কী অক্ষর?
ঈশিতা উত্তর দিল, বলল, প্রথমটা ক, তার পরেরটা হচ্ছে ল, তার পরেরটা হচ্ছে ম। তিনটা মিলে হচ্ছে কলম।
শারমিন তার পরের শব্দটার দিকে আঙুল দিয়ে বলল, তার মানে এটা হচ্ছে কমল?
ভেরি গুড। হ্যাঁ এটা হচ্ছে কমল। তার পরের শব্দটা হচ্ছে কমলা। লএর পর আকার থাকায় এটা হচ্ছে না।
শারমিন বইয়ে লেখা শব্দগুলো দেখিয়ে বলতে থাকে, তার মানে এটা কাল? এটা লাল? এটা কলা? এটা কামাল? এটা মাকাল? এটা কালাম? এটা মালা? এটা কম? এটা মাল? এটা কাম? এটা মালা?
ঈশিতা হেসে ফেলল। বলল, আস্তে আস্তে! তিনটা অক্ষর আর আকার দিয়েই এত কিছু পড়ে ফেলতে পারছ, সবগুলো শিখে ফেললে কী হবে?
রাফি বলল, হ্যাঁ, এই বইটা ভারি চমৎকার, তিনটা অক্ষর আর আকার দিয়েই অনেক শব্দ শিখিয়ে দেয়!
ঈশিতা বলল, আমার ধারণা, পুরো ক্রেডিট বইটার না! আমাদের শারমিনকেও একটু ক্রেডিট দিতে হবে।
সে তো দিচ্ছিই!
শারমিন লোভাতুর দৃষ্টিতে অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ঈশিতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নাকি চোখের পলকে অনেক বড় বড় গুণ করে ফেলতে পারো?
শারমিন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল। ঈশিতা বলল, বলো দেখি তেহাত্তরকে সাতানব্বই দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
শারমিন বলল, সাত হাজার একাশি।
ঈশিতা রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক হয়েছে?
রাফি বলল, শারমিন যখন বলেছে, নিশ্চয়ই ঠিক হয়েছে।
ঈশিতা শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে এটা করো?
শারমিন মাথা নাড়ল, বলল জানি না। আমি চিন্তা করলেই উত্তরটা জেনে যাই।
চিন্তা করলেই জেনে যাও?
হ্যাঁ। মনে হয় যেন দেখতে পাই।
দেখতে পাও? সংখ্যা দেখতে পাও?
শারমিন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমি তো লেখাপড়া জানি না, তাই কোন সংখ্যা দেখতে কেমন সেইটা জানি না! আমি নিজের মতন দেখি—কোনোটা গোল, কোনোটা লম্বা, কোনোটা চিকন, সেগুলো নড়ে।
কী আশ্চর্য!
শারমিন কিছু না বলে তার বর্ণমালার বই আর লাল প্লাস্টিকটা বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এর মধ্যে কোনটা আশ্চর্য সে এখনো বুঝতে পারছে না। রাফি বলল, তুমি বলছ তুমি চিন্তা করলেই উত্তরটা জেনে যাও। তুমি কী চিন্তা করো?
গুণফলটা কী হবে সেটা চিন্তা করি।
তুমি মাথার মধ্যে গুণ করো না?
না। কেমন করে গুণ করতে হয় আমি জানি না।
রাফি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলেন ব্যাপারটা? শারমিন কেমন করে গুণ করতে হয় জানে না, কিন্তু গুণ না করেই যেকোনো দুটি সংখ্যার গুণফল বের করে ফেলে!
কেমন করে?
আমি যদি জানতাম!
রাফি কথা বলতে বলতে টংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে হঠাৎ করে অনেকেই চলে এসেছে, শারমিনের বাবা একা সামাল দিতে পারছে না। রাফি শারমিনকে বলল, তুমি এখন যাও। তোমার আব্বুকে সাহায্য করো।
শারমিন তার বুকে চেপে রাখা বর্ণমালার বই আর লাল প্লাস্টিকটা দেখিয়ে বলল, এই বইটা?।
তোমার জন্য। তুমি নিয়ে যাও। বাসায় গিয়ে পড়ো। কাউকে বলো একটু দেখিয়ে দিতে। ঠিক আছে?
শারমিন মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখমুখ কৃতজ্ঞতায় ঝলমল করে উঠল। রাফি আগেও দেখেছে, এ দেশে মানুষেরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ধন্যবাদ কথাটি উচ্চারণ করা শেখেনি, তাই চোখেমুখে সেটা প্রকাশ করতে হয়।
শারমিনের পিছু পিছু টংয়ে এসে রাফি দেখল, সেখানে একটা ছোটখাটো উত্তেজনা। উত্তেজনার কেন্দ্রস্থল সমীর—বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। রাফি গলা নামিয়ে ঈশিতাকে বলল, ওই যে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ছেলেটাকে দেখছেন, সে হচ্ছে সমীর। কঠিন সায়েন্টিস্ট। সব সময় ব্যাক্টেরিয়া আর ভাইরাস নিয়ে কথা বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে!