ঈশিতা বলল, আমি মোটেও এটা নিয়ে পত্রিকায় আর্টিকেল লিখতে ব্যস্ত হইনি।
তাহলে?
আমি এটা জানতে চাই।
কেন?
ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা আমি আপনাকে বলতে পারব না। খুব যদি চাপাচাপি করেন তাহলে আমি বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেব—আপনি টেরও পাবেন না যে আমি মিথ্যে কথা বলছি। আমি খুব সরল মুখ করে সিরিয়াস ব্লাফ দিতে পারি।
রাফি হেসে বলল, আপনাকে ব্লাফ দিতে হবে না। আমি চাপাচাপি করব না! তবে আপনি যেসব জিনিস জানতে চাইছেন, আমি যে তার সবকিছু জানি, তা না। শুধু যে জানি না, তা না। অনেক কিছু আছে যেগুলো আমি কেন, পৃথিবীর কেউই জানে না।
কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই সেগুলো জানতে চাইছেন, চাইছেন না?
তা চাইছি।
আমার অনুরোধ, আপনি যদি কিছু জানেন সেটা আমাকে কষ্ট করে একটু বুঝিয়ে দেবেন। আর কিছু না।
রাফি বলল, ঠিক আছে। যদি আপনারা এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া না করেন, তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই।
কথা দিচ্ছি টানাহ্যাচড়া করব না।
তাহলে ঠিক আছে।
ঈশিতা বলল, ভেরি গুড। আমি তাহলে এখন উঠি।
কোথায় যাবেন?
হেলাল নামক ছেলেটার সঙ্গে একটু কথা বলি। তাকে খুশি করার জন্য দু-চারটা ছবি তুলতে হবে। ঈশিতা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, এই হেলাল খুব করিৎকর্মা ছেলে হতে পারে, কিন্তু তার বাংলা বানানের জ্ঞান ভালো না। দন্ত্যস দিয়ে মানুষ লিখে।
রাফি হাসল, নেতা মানুষ বানান দিয়ে কী করবে?
ঈশিতা ভুরু কুঁচকে বলল, নেতা নাকি?
হ্যাঁ। সিরিয়াস নেতা।
তাহলে একটু সাবধানে ডিল করতে হবে।
ঈশিতা তার ক্যামেরা ঘাড়ে ঝুলিয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছে, তখন রাফি একটু ইতস্তত করে বলল, আজ বিকেলে আপনার কী প্রোগ্রাম?
কোনো প্রোগ্রাম নেই।
পাঁচটার দিকে ছাত্রদের বাসটা চলে যাওয়ার পর ক্যাম্পাস একটু ফাঁকা হয়। আমি ঠিক করেছিলাম তখন আপনার কম্পিউটার মেয়েটাকে নিয়ে একটু বসব। আপনি চাইলে তখন আপনিও আমার সাথে থাকতে পারেন।
অবশ্যই থাকব। একশবার থাকব।
তাহলে আপনি সাড়ে পাঁচটার দিকে চলে আসবেন আমার রুমে।
আসব।
শুধু একটা কন্ডিশন—
ঈশিতা বলল, মেয়েটাকে নিয়ে কোনো রিপোর্ট করা যাবে না!
হ্যাঁ।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। আমি রিপোর্ট করব না।
বিকেল বেলা রাফি তার ঘর থেকে ঈশিতাকে নিয়ে বের হলো। বের হওয়ার আগে সে টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে নেয়—ক্লাস ওয়ানের বর্ণমালা শেখার বই।
ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, এই বইটি কেন?
আপনাকে যে মেয়েটির কাছে নিয়ে যাচ্ছি সেই মেয়েটি বিশাল বিশাল সংখ্যাকে মুহূর্তের মধ্যে গুণ করে ফেলতে পারে, কিন্তু একটা অক্ষরও পড়তে পারে না!
ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। মেয়েটার ডিসলেক্সিয়া।
ডিসলেক্সিয়া? ঈশিতা মাথা নেড়ে বলল, আমি এটার কথা শুনেছি। আজকাল দুষ্টু বাচ্চাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই বলা হয় ডিসলেক্সিয়া, না হয় এডিডি-অ্যাটেনশন ডেফিশিয়েন্সি ডিজঅর্ডার। তারপর কিছু বোঝার আগেই প্রোজাক প্রেসক্রিপশন করে দেয়। দেখতে দেখতে চটপটে একটা বাচ্চা কেমন যেন ভেজিটেবলের মতো হয়ে যায়।
রাফি বলল, আমি যে মেয়েটার কাছে নিচ্ছি সে মোটেও দুষ্টু নয়, অ্যাটেনশনেরও সমস্যা নেই। মেয়েটা হচ্ছে একেবারে ক্ল্যাসিক কেস অব ডিসলেক্সিয়া। মেয়েটা সে জন্য পড়তে শেখেনি। আমি এই বইটা নিয়ে যাচ্ছি তাকে একটু টেস্ট করার জন্য!
ঈশিতা মাথা নেড়ে বলল, ইন্টারেস্টিং।
টংয়ের কাছে গিয়ে রাফি দেখল সেখানে খুব ভিড়। জিলাপি ভাজা হচ্ছে এবং অনেকে সেই জিলাপি খাচ্ছেন শারমিন প্লেটে করে জিলাপি দিচ্ছে, চা দিচ্ছে এবং কার কত বিল হয়েছে, সেটা জানিয়ে দিচ্ছে। রাফি ঈশিতাকে গলা নামিয়ে বলল, এই হচ্ছে সেই মেয়ে, নাম শারমিন।
কী সুইট মেয়েটা।
হ্যাঁ, অনেক সুইট।
রাফিকে দেখে শারমিনের বাবা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শারমিনকে বলল, স্যারের জন্য বেঞ্চটা মুছে দে তাড়াতাড়ি।
রাফি বলল, বেঞ্চ মুছতে হবে না। বরং শারমিনকে আমার কাছে পাঠান পাঁচ মিনিটের জন্য।
জি স্যার! জি স্যার। বাবা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শারমিনকে বলল, দেখ দেখি স্যার কী বলেন।
শারমিন সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্রকে হাত মুছে কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, জি স্যার।
রাফি বলল, আমি তোমার একটা জিনিস একটু টেস্ট করতে চাই। তুমি একটু আমার সঙ্গে আসো, আমরা ওই পাশে গিয়ে বসি।
রাফি ঈশিতাকে নিয়ে টংয়ের কাছে বড় একটা গাছের পাশে বসল। শারমিন বসল তাদের সামনে, তার চোখেমুখে এক ধরনের উত্তেজনা।
রাফি তার বইটা বের করে বলল, আমি একটা বই নিয়ে এসেছি, দেখি তুমি এটা পড়তে পার কি না।
শারমিনের মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেল, সে ফিস ফিস করে বলল, আমি তো পড়তে পারি না স্যার।
আমি জানি। আমি দেখতে চাই তুমি কতটুকু পারো।
একটুও পারি না।
ঠিক আছে। তোমাকে পড়তে হবে না, তুমি আমাকে বলো তুমি কী দেখো। রাফি বইয়ের একটা পৃষ্ঠা খুলে বলল, এখানে কী আছে বলো।
শারমিনের মুখটা কেমন জানি শুকনো হয়ে যায়, জিব দিয়ে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে বলল, কয়েকটা আকাবাকা দাগ নড়ছে।
ঈশিতা অবাক হয়ে বলছে, নড়ছে?
শারমিন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
কেমন করে নড়ছে?
ডানে-বাঁয়ে। মাঝে মধ্যে উল্টে যায়।
ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য।
রাফি বলল, মোটেও আশ্চর্য না। এটা হচ্ছে ডিসলেক্সিয়ার লক্ষণ।
ঈশিতা বলল, হতে পারে, কিন্তু তবুও আশ্চর্য।