এই কথাটায় ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। টেলিফোনের অন্য পাশে হেলাল নামের ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনি যখন এভাবে বলছেন, দেখি চেষ্টা করে। সমস্যা হয়েছে একজন চ্যাংড়া টিচার নিয়ে।
কী হয়েছে এই চ্যাংড়া টিচারের?
এই হ্যানো ত্যানো বড় বড় কথা! বাচ্চা মেয়ে, তাকে রেডিওটেলিভিশনে নেওয়া ঠিক না—এই সব বড় বড় বোলচাল।
আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন— ঈশিতা বলল, আমি আপনার চ্যাংড়া টিচারকে ম্যানেজ করে নেব।
রাফি লেকচার তৈরি করতে করতে মুখ তুলে দেখে দরজায় ফতুয়া এবং জিন্স পরা তেজি ধরনের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির কাঁধ থেকে বিশাল একটা ক্যামেরা ঝুলছে। মেয়েটি ঈশিতা এবং রাফি ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেনি সে তাকে ম্যানেজ করতে ঢাকা চলে এসেছে। রাফি থতমত খেয়ে বলল, আমার কাছে?
আপনি কি রাফি?
হ্যাঁ।
তাহলে আপনার কাছে। ঈশিতা ভেতরে ঢুকল, একটা চেয়ার টেনে বসল, ক্যামেরাটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, আমার নাম ঈশিতা। আমি
একটা পত্রিকায় কাজ করি। ঢাকা থেকে এসেছি।
রাফি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঈশিতা হাসিমুখ করে বলল, পত্রিকার মানুষকে অনেকে ভয় পায়। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
রাফি বলল, না, আমি ভয় পাচ্ছি না। আমি মাকড়সা ছাড়া আর কিছু ভয় পাই না।
বলতেই হবে আপনি খুব সাহসী মানুষ। আমি তেলাপোকা, জোঁক, কেঁচো, সাপ এবং অন্য যেকোনো পিছলে জিনিস যেটা নড়ে সেটাকে ভয় পাই।
রাফি হাসার ভঙ্গি করে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল, সে কেন তার কাছে এসেছে। ঢাকা থেকে একজন সাংবাদিকের তার কাছে চলে আসার খুব বেশি কারণ থাকার কথা নয়—সম্ভবত কোনোভাবে শারমিনের খোঁজ পেয়েছে।
ঈশিতা হঠাৎ মাথাটা একটু এগিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আমি আসলে আপনাকে ম্যানেজ করতে এসেছি!
ম্যানেজ করতে? রাফি চোখ বড় বড় করে বলল, আমাকে?
হ্যাঁ। আপনাদের একজন ছাত্রের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, নাম হেলাল। সে আমাকে বলেছে, আপনাকে যদি আমি কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারি, তাহলে সে আমাকে একটা মানুষ কম্পিউটার দেখাবে!
আমাকে ম্যানেজ করলে?
হ্যাঁ।
কীভাবে ম্যানেজ করবেন, ঠিক করেছেন?
এখনো করিনি। সেই জন্য আগে আপনাকে একটু দেখতে চেয়েছিলাম!
দেখেছেন?
হ্যাঁ। এখন মনে হচ্ছে আসলে ম্যানেজ করার দরকার নেই। হয়তো ম্যানেজ না হয়েই আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন।
কী সাহায্য?
ঈশিতা কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা ভাবল, তারপর বলল, আমি জার্নালিজম পড়েছি। কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি, ই-মেইল পাঠাতে পারি, গুগলে সার্চ দিতে পারি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারি কিন্তু কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, তার কিছু জানি না। জানার দরকারও ছিল না, কোনো উৎসাহও ছিল না। কিন্তু–
কিন্তু?
কিন্তু এখন আমার হঠাৎ খুব জানার দরকার, কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইন্টারনেটে ঠেলাঠেলি করে কিছু একটা হয়তো জানতে পারতাম—কিন্তু তাতে সমস্যা হচ্ছে যে আমি তখন ঠিক জিনিসটা শিখতে পারতাম না। আমার মনে হলো, যদি কেউ আমাকে একটু বলে দিত তাহলে আমি জিনিসটা ঠিক করে বুঝতে পারতাম।
রাফি ইতস্তত করে বলল, কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, সেটা আমার কাছ থেকে জানার জন্য আপনি ঢাকা থেকে চলে এসেছেন? আজকাল কত বই, কত কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, কত কম্পিউটার সেন্টার।
হ্যাঁ। আছে, কিন্তু তারা যে কম্পিউটার নিয়ে কথা বলে সেটা হচ্ছে। ডিজিটাল কম্পিউটার। আমার জানার দরকার নিউরাল কম্পিউটার।
রাফি এবার তার চেয়ারে হেলান দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল, নিউরাল কম্পিউটার?
হ্যাঁ। ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, বইপত্র, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে। আমি যেটা জেনেছি সেটা হচ্ছে, মানুষের ব্রেন আমাদের ল্যাপটপের মতো কাজ করে না—ল্যাপটপ হচ্ছে ডিজিটাল কম্পিউটার। মানুষের ব্রেনের মধ্যে আছে নিউরন, সেটা দিয়ে তৈরি হয়েছে নিউরাল নেটওয়ার্ক। নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়ে কেউ কম্পিউটার তৈরি করলে সেটা হবে নিউরাল কম্পিউটার। ঠিক বলছি?
রাফি মাথা নাড়ল। ঈশিতা বলল, অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হতে পারে। উল্টাপাল্টা কিছু বললে থামাবেন। আমি আপনার কাছে এসেছি দুটি কারণে। এক. গত আইসিটি আইটি কনফারেন্সে আপনি নিউরাল নেটওয়ার্কের ওপর একটা পেপার দিয়েছেন। পেপারটা আমি পড়েছি, একটা লাইন দূরে থাকুক, একটা শব্দও বুঝিনি।
রাফি বলল, সরি।
ঈশিতা বলল, আপনার সরি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সেই পেপারটা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি নিউরাল কম্পিউটারে এক্সপার্ট।
আমি মোটেও এক্সপার্ট না।
যখন কারও লেখার একটা শব্দও বোঝা যায় না, তখন সে হচ্ছে এক্সপার্ট। আপনি অবশ্যই এক্সপার্ট। যাই হোক— ঈশিতা রাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আপনার ইউনিভার্সিটির হেলাল নামে একটা ছেলে আমাকে বলেছে, এখানে একজন মেয়ে হচ্ছে মানুষ কম্পিউটার! আপনি নিশ্চয়ই সেই মেয়েটাকে চেনেন। নিশ্চয়ই জানেন মেয়েটা কেমন করে কম্পিউটার। গবেষণা করার একটা মানুষ কম্পিউটার আপনার কাছে আছে, যেটা অন্য কারও কাছে নেই। আমি আপনার কাছে জানতে চাই, মেয়েটা কেমন করে এটা করে!
ঈশিতা তার টানা বক্তব্য শেষ করে চেয়ারে হেলান দিল। রাফি কিছুক্ষণ ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এত জিনিস থাকতে আপনি এই জিনিস পত্রিকায় লিখতে এত ব্যস্ত হলেন কেন?