রাফি বলল, তার বাবা কাউকে বলতে না করেছে, সেই জন্য সবার সামনে বলিনি। নাম হান্নান। সবাই ডাকে ভোটকা হান্নান।
কখনো নাম শুনিনি। যাই হোক মেয়ের বাবাকে বলো চিন্তা না করতে। উই উইল টেক কেয়ার।
আপনাকে হয়তো কিছু করতে হবে না, শারমিনের বাবা হান্নানকে বুঝিয়েছে শারমিনের খুব কঠিন অসুখ। অসুখের নাম ডিসলেক্সিয়া। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। কাজেই আমি অনুমতি না দিলে তাকে কোথাও নেওয়া যাবে না।
প্রফেসর হাসান হাসলেন, ভালোই বলেছে। স্মার্ট ম্যান।
কাজেই মনে হয় আমার কাছে ওই মাস্তান আসবে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করব। আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।
ভালো করেছ। দরকার হলে আমি দেখব। ওই মাস্তানদের কোনো পাত্তা দেবে না।
রাফি মাথা নাড়ল। বলল, না স্যার পাত্তা দেব না।
পরদিন সকালে রাফি ইন্টারনেটে ডিসলেক্সিয়া নিয়ে পড়াশোনা করছে, অবাক হয়ে দেখল আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো, টমাস এডিসন থেকে শুরু ওয়াল্ট ডিজনি, টম ক্রুজ—সবাই নাকি ডিসলেক্সিক! মনে হচ্ছে। ডিসলেক্সিয়া না হওয়া পর্যন্ত কোনো সৃজনশীল কাজ করা যায় না।
ঠিক এ রকম সময় দরজা থেকে নাকি গলার স্বরে কে যেন বলল, আসতে পারি?
রাফি তাকিয়ে দেখে অসম্ভব শুকনো একজন ছেলে, টেলিভিশনে এইডসের রোগীদের অনেকটা এ রকম দেখায়। গালভাঙা এবং কোটরাগত চোখ, তবে মাথায় বাহারি চুল। রাফি বলল, আসো।
ছেলেটি ভেতরে ঢুকে বলল, আপনার সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি।
তুমি কে?
ছেলেটি একটু থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম হান্নান।
তুমি কি আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্র?
না। আমি ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের। ফোর্থ ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার।
কী ব্যাপার। বলো।
আমাকে চিনেছেন স্যার? ক্যাম্পাসে সবাই আমাকে চিনে।
আমি নতুন এসেছি সবাইকে চিনি না।
আমি তো স্যার ছাত্র সংগঠন করি, আমাকে অনেকে ভোটকা হান্নান বলে।
রাফি এবার কষ্ট করে তার বিস্ময় গোপন করল। বলল, ও আচ্ছা। তোমাকে ভোটকা হান্নান ডাকে?
ছেলেটি একটু হাসল, তার প্রয়োজনের চাইতে বেশি দাত, দাঁতের রং হলুদ, মাঢ়ির রং কালো। বলল, জি স্যার।
নামটা ঠিক হয়নি।
জানি স্যার।
সময় কী বলবে বলো।
ভোটকা হান্নান কীভাবে কথাটা শুরু করবে, রাফি সেটা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
ভোটকা হান্নান গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, আমাদের যে টংগুলো আছে। সেখানে মাহতাবের একটা টং আছে। খুবই গরিব স্যার, আমরা হেল্প করার জন্য এই টংটা বানিয়ে দিয়েছি।
রাফি বলল, ভেরি গুড।
মাহতাবের ছোট মেয়ে তার বাবাকে সাহায্য করে, আমরাও দেখেশুনে রাখি। সেই মেয়ে নাকি বড় বড় গুণ মুখে মুখে করে ফেলে। আমি ভাবলাম, মেয়েটাকে একটু সাহায্য করি।
ভোটকা হান্নান তার মুখে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলল, ঢাকায় টিভি চ্যানেল, পত্রিকার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আমি ভাবছি কয়েকটা চ্যানেলে প্রোগ্রাম করিয়ে—
রাফি এবার তাকে থামাল। বলল, দেখো হান্নান, ওই মেয়েটা যে এভাবে গিফটেড সেটা কেউ জানত না। আমি বের করেছি। আমি আরও একটা জিনিস বের করেছি, সেটা হচ্ছে মেয়েটা সিরিয়াসলি ডিসলেক্টিক। ওই মেয়েটার সাহায্য দরকার, রেডিও-টেলিভিশনে তার এক্সপোজারের কোনো দরকার নেই।
কিন্তু স্যার যদি টেলিভিশনে দেখিয়ে সাহায্য চাওয়া যায়—
ছিঃ! সাহায্য চাইবে কেন? সাহায্য মানে তো ভিক্ষা, এই বাচ্চা মেয়ে ভিক্ষা করবে কেন?
ভোটকা হান্নান একটু থতমত খেয়ে গেল। টাকা-পয়সা তার কাছে সব সময়ই অমূল্য জিনিস, সেটা চাঁদাবাজি করেই আসুক আর ভিক্ষে করেই আসুক, সেটাকে কেউ এভাবে ছিঃ বলে উড়িয়ে দিতে পারে, আগে বুঝতে পারেনি। সে আবার চেষ্টা করল। বলল, টেলিভিশনে দেখালে একটা পরিচিতি হবে–
রাফি এবার একটু কঠিন মুখ করে বলল, দেখো হান্নান, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ জানি না। আমি এই ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে জুনিয়র টিচার, এক সপ্তাহও হয়নি জয়েন করেছি। এই মেয়েটিকে নিয়ে তুমি টিভিতে যাবে, না সিনেমাতে যাবে সেটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলার দরকার থাকার কথা নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে যে কারণে তুমি তাকে টিভিতে নিতে যাচ্ছাে, সেই কারণটা আমি বের করেছি। কাজেই আমার একটু দায়দায়িত্ব এসে পড়েছে। বুঝেছো?
জি স্যার, কিন্তু–
আমার কথা আগে শেষ করি। রাফি মুখ আরও কঠিন করে বলল, আমি এই মেয়ের গার্জিয়ান না, কিন্তু যে গার্জিয়ান তাকে বলল, যদি সে মেয়ের ভালো চায়, যেন কোনোভাবেই তাকে রেডিও-টেলিভিশনে না পাঠায়।
কিন্তু স্যার, আমি অলরেডি চ্যানেলে, খবরের কাগজে যোগাযোগ করেছি, তারা রাজি হয়েছে।
আবার যোগাযোগ করো। করে বলো সম্ভব নয়।
ভোটকা হান্নান এবার তার নিজের মুখটা কঠিন করে বলল, না স্যার, আমি সেটা করব না। যেহেতু কথা দিয়েছি, কথা রাখতে হবে স্যার।
ভেরি গুড। কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছ? যদি জোর করে এই মেয়েকে তুলে নিতে চাও, সেটা তোমার ব্যাপার। বাচ্চা মেয়ে গার্ডিয়ানের অনুমতি ছাড়া তুলে নিয়ে স্ট্রেট শিশু অপহরণের মামলায় পড়ে যাবে।
ভোটকা হান্নান তার কালো মাঢ়ি এবং দুই প্রস্থ হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সাহস কেউ করবে না! আপনি নতুন এসেছেন তাই জানেন না। এমনি এমনি আমার নাম ভোটকা হান্নান হয়নি।
ঠিক আছে ভোটকা হান্নানতুমি যেটা করতে চাও করো। আমি আমাদের হেডকে জানাব। স্যার। যদি চান প্রক্টর, ভিসি, পুলিশকে জানাবেন। তুমি তোমারটা করবে, আমি আমারটা করব।