চাঁদা? কাকে চাঁদা দিতে হয়?
ছাত্রনেতাদের। তারা এসে যখন খুশি ফাও খায়, আবার দৈনিক চাঁদা নেয়।
কী আশ্চর্য!
না স্যার, এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই। এইটাই নিয়ম, যখন যেই দল ক্ষমতায়, তখন সেই দলকে চাঁদা দিই। সেইটা সমস্যা না। সেইটা আমরা সবাই মেনে নিয়েছি।
তাহলে সমস্যাটা কী?
শারমিনের বাবা আরেকটু এগিয়ে এসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, ক্যাম্পাসে এখন যে সবচেয়ে বড় ছাত্রনেতা, তার নাম হান্নান। অনেক বড় মাস্তান, সবাই ডাকে ভোটকা হান্নান।
কী করেছে ভোটকা হান্নান?
সেই দিন আমার টংয়ে এসে আমারে জিজ্ঞেস করে, এই, তোর মেয়ে নাকি অঙ্কের এক্সপার্ট। আমি বললাম, সেইটা তো জানি না, তাকে যোগবিয়োগ করতে দিলে করতে পারে। তখন ভোটকা হান্নান শারমিনকে টেস্ট করল। যেটাই গুণ দিতে বলে শারমিন করে দেয়। তখন, তখন মানুষটি হঠাৎ কথা বন্ধ করে থেমে গেল।
তখন কী?
ভোটকা হান্নান এখন শারমিনরে তুলে নিতে চায়।
তুলে নিতে চায়? রাফি তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, তুলে নিতে চায় মানে কী?
শারমিনরে নাকি ঢাকায় নিয়ে যাবে, টেলিভিশনে দেখাবে। শারমিনের বাবা একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। বলল, স্যার, আপনি যদি আমারে বলতেন শারমিনরে ঢাকায় টেলিভিশনে নিবেন, স্যার আমি তাহলে খুশি হয়ে রাজি হতাম। আপনি সেদিন মেয়েটারে বলেছেন, তাকে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। মেয়েটা কী খুশি! বাড়িতে গিয়ে তার মাকে কতবার সেই কথাটা বলেছে। স্যার, আপনাদের ওপর ভরসা করে আমরা থাকি। তাই বলে ভোটকা হান্নান? সে কেন আমার এই ছোট মেয়েটার দিকে নজর দিবে?
রাফি মাথা নাড়ল। বলল, না না, এটা তো হতেই পারে না। আমি দেখি কী করা যায়।
কিন্তু স্যার ভোটকা হান্নান যদি জানে আমি আপনার কাছে নালিশ দিয়েছি, তাহলে স্যার আমার লাশ পড়ে যাবে স্যার।
তাহলে কেমন করে হবে? আমি যদি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর বা কাউকে বলতে যাই–
না না স্যার, সর্বনাশ! কাউরে বলা যাবে না।
তাহলে?
স্যার, আপনি বলেছিলেন না শারমিনের একটা ব্যারাম আছে। কঠিন ব্যারাম—ডিষ্টিমিষ্টি না কী যেন নাম।
ব্যারাম নয়, একটা ডিজঅর্ডার, ডিসলেক্সিয়া।
জি স্যার। আমি ভোটকা হান্নানকে সেটা বলেছি। আমি বলেছি, আপনি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। আপনার পারমিশন ছাড়া শারমিনকে কোথাও নেওয়া যাবে না।
গুড। রাফি হাসি হাসি মুখে বলল, ভেরি গুড। বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছেন।
ভোটকা হান্নান যদি আপনার কাছে আসে, আপনি তারে বলবেন, শারমিনকে কোথাও নেওয়া ঠিক হবে না।
ঠিক আছে বলব। আপনি চিন্তা করবেন না।
শারমিনের বাবা চলে যাওয়ার পরও রাফি চুপচাপ তার ডেস্কে বসে রইল। এই দেশে সাধারণ মানুষের জীবনটা বড় কঠিন।
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার পর ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক তাদের সাপ্তাহিক মিটিং করতে বসে। এই মঙ্গলবার মিটিংটা শুরু করার পর দেখা গেল আলোচনা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নেই। রাশেদ স্যার সুযোগ পেলেই জটিল একটি গবেষণার বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন বলে কম বয়সী লেকচারাররা একটার পর একটা হালকা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে শুরু করল। প্রফেসর হাসান সেই বিষয়গুলো সমান উৎসাহে আলোচনা করতে থাকলেন। একসময় রোফির দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর রাফি তোমার ক্লাস কেমন চলছে?
রাফি বলল, ভালো স্যার।
সুহানা বলল, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীষণ পপুলার। বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে।
সব শিক্ষক শব্দ করে এক ধরনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। প্রফেসর হাসান ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার? একজন ইয়ং হ্যান্ডসাম মানুষকে তার ছাত্রীরা পছন্দ করছে—তাতে তোমরা এত হিংসা করছ কেন?
রানা বলল, না স্যার, আমরা মোটেও হিংসা করছি না—শুধু একটু সতর্ক করে দিতে চাইছি।
কী নিয়ে সতর্ক করবে?
ওদের হাইফাই ইউনিভার্সিটির ছাত্রীরা লেখাপড়া ছাড়া কিছু বোঝে —সবাই হচ্ছে লেবদু টাইপের। আমাদের ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের অসম্ভব তেজ!
কবির বলল, সুহানাকে দেখলেই বোঝা যায়!
সুহানা প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই প্রফেসর হাসান রাফিকে জিজ্ঞেস করলেন, নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আমি খোঁজও নিতে পারছি না—
না স্যার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সবাই খুব হেল্পফুল। ক্লাসও খুব ইন্টারেস্টিং, ক্লাসের বাইরেও খুব ইন্টারেস্টিং।
সুহানা জানতে চাইল, ক্লাসের বাইরে ইন্টারেস্টিং কী হলো?
রাফি বলল, আমরা যে টংয়ে চা খেতে যাই, সেখানে শারমিন নামের একটা ছোট মেয়ে আছে। সেই মেয়েটা যেকোনো ডিজিটের সংখ্যা দিয়ে যেকোনো ডিজিটের সংখ্যা গুণ করে ফেলতে পারে। আমার মোবাইলে যে ক্যালকুলেটর আছে সেটা নয় ডিজিটের—আমি সেটা দিয়ে টেস্ট করেছি।
রাশেদ বললেন, নয় ডিজিট তো অনেক।
রাফি বলল, হ্যাঁ। আমরা দুই ডিজিটের সংখ্যাকে কষ্ট করে পারি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েটার এক মুহূর্ত দেরি হয় না—তাকে কিছু করতে হয় না, সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়।
রানা বলল, আশ্চর্য তো! আমাদের শারমিন? টংয়ের শারমিন?
হ্যাঁ।
সুহানা বলল, আমরা চা-শিঙাড়া খেলেই সে বিল বলে দেয়। আমি মনে করতাম, বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
রাফি বলল, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েটার কোনো ফরমাল লেখাপড়া নেই। এক শ পর্যন্ত গুণতে পারে। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ—এসবের কনসেপ্ট নেই। এমনি গুণ করতে বললে পারে না—একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়। এতজন মানুষ এতগুলো বিস্কুট খেয়েছে, বিল কত হবে—এভাবে!