রাফি হতবাক হয়ে বলল, লেখাপড়া করে না?
না। আমি কম চেষ্টা করি নাই। করতে চায় না।
রাফি হিসাব মেলাতে পারল না, যে মানুষ অবলীলায় যেকোনো সংখ্যার সঙ্গে অন্য যেকোনো সংখ্যা গুণ করে ফেলতে পারে, সে লেখাপড়া করতে চাইবে না কেন? রাফি শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি লেখাপড়া করতে চাও না?
শারমিন কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রাফি লক্ষ করল, তার মুখে লজ্জা এবং বেদনার ছাপ। রাফি গলার স্বর নরম করে বলল, করতে চাও না?
শারমিন অস্পষ্ট স্বরে বলল, চাই। কিন্তু—
কিন্তু কী?
এবারও রাফির প্রশ্নের উত্তর দিল শারমিনের বাবা। বলল, ওর কথা আর বলবেন না। যখন পড়তে যায়, তখন নাকি বইয়ের লেখা উল্টা হয়ে যায়—তারপর নাকি নড়েচড়ে লাফায়, সে নাকি পড়তে পারে না।
রাফি চোখ বড় বড় করে বলল, ডিসলেক্সিয়া!
শারমিন আর তার বাবা দুজনই রাফির দিকে তাকাল। বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?
ডিসলেক্সিয়া। যাদের ডিসলেক্সিয়া থাকে, তাদের এ রকম হয়, লেখাপড়া করতে পারে না। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ আছে, যারা খুবই স্মার্ট কিন্তু লেখাপড়া জানে না।
শারমিন রাফির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই রোগের চিকিৎসা নাই?
এটা তো রোগ না, এটা হচ্ছে ব্রেনের এক ধরনের সমস্যা। বিদেশে বাচ্চাদের ডিসলেক্সিয়া থাকলে তাদের স্পেশাল স্কুল থাকে। আমাদের দেশে সেরকম কিছু নেই, বাবা-মা, মাস্টাররা মনে করে, বাচ্চাটা দুষ্টু, পড়ায় মনোযোগ নেই, বকাঝকা করে মারধর করে।
শারমিন নিচু গলায় বলল, স্কুলেও আমাকে অনেক মারত।
শারমিনের বাবা অপরাধীর মতো বলল, আমিও কত মেরেছি।
রাফি বলল, মারধর ইজ নো সলিউশন। শারমিনের কোনো দোষ নেই। বেচারি পারে না। ওর ডিসলেক্সিয়া।
শারমিন রাফির কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করল, বিদেশে এই রোগের চিকিৎসা আছে?
মেয়েটির গলার স্বরে এক ধরনের ব্যাকুলতা। রাফির খুব মায়া হলো, নরম গলায় বলল, এটা তো রোগ না, তাই এর চিকিৎসা নেই। কিন্তু যেহেতু এটা একটা সমস্যা, তাই এই সমস্যাটাকে বাইপাস করার উপায় নিশ্চয়ই বের করেছে। যারা অন্ধ, তারাও তো লেখাপড়া করে, তাহলে তুমি পারবে না কেন?
শারমিন ফিসফিস করে, শোনা যায় না, এ রকম স্বরে বলল, স্যার, আমার খুব লেখাপড়া করার ইচ্ছা।
রাফি বলল, নিশ্চয়ই তুমি লেখা পড়া করবে। আমি দেখব।
রাফি টং থেকে উঠে আসার সময় লক্ষ করল, আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের বেশ কয়েকজন শারমিনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। একজন উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করছে, বল দেখি, তিন শ বাইশকে সাত শ নয় দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
রাফি হেঁটে চলে গেল বলে শারমিন কী বলল, সেটা ঠিক শুনতে পারল। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে এই বাচ্চা মেয়েটির জন্য একটি সমস্যা হতে পারে।
দুই দিন পর রাফি সমস্যার মাত্রাটা টের পেল। নিজের অফিস ঘরে গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্লাস লেকচার ঠিক করছে, তখন দরজায় একজন মানুষের ছায়া পড়েছে। রাফি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে লুঙ্গি পরা আধবুড়ো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। রাফি জিজ্ঞেস করল, কে? আমার কাছে?
জি।
আসেন।
মানুষটা কুষ্ঠিতভাবে ভেতরে এসে ঢোকে। রাফির কাছে মানুষটিকে চেনা চেনা মনে হয়, কিন্তু সে ঠিক চিনতে পারে না। তখন মানুষটি নিজেই পরিচয় দিল। বলল, স্যার, আমি শারমিনের বাবা।
ও আচ্ছা! হ্যাঁ, বসেন। রাফি নিজেই অবাক হয়ে যায়, সে কেমন করে শারমিনের বাবাকে চিনতে পারল না। এর আগেও এ রকম ব্যাপার ঘটেছে, যে মানুষটিকে যেখানে দেখার কথা, সেখানে দেখলে কখনোই চিনতে ভুল হয় না। কিন্তু যেখানে থাকার কথা না, সেখানে দেখলে চট করে চিনতে পারে না।
শারমিনের বাবা বসল না। কাচুমাচু মুখে বলল, স্যার, বড় বিপদে পড়েছি।
কী বিপদ!
শারমিনকে নিয়ে বিপদ।
রাফি ভুরু কুঁচকে বলল, শারমিনকে নিয়ে?
জি স্যার। বিপদটা কী সেটা না বলে মানুষটি বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
রাফি বলল, বলেন, শুনি।
শারমিনের বাবা একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অনেক খুঁজে আপনার কাছে এসেছি। আপনি স্যার নতুন এসেছেন, সবাই চিনে না, সে জন্য খুঁজে বের করতে সময় লেগেছে।
হ্যাঁ, আমি নতুন এসেছি।
স্যার, মনে আছে, আপনি সেদিন শারমিনকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন? শারমিন তার উত্তর দিল।
হ্যাঁ। মনে আছে।
তখন অনেক ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়েছিল, তারা ব্যাপারটা দেখেছে। এখন তারা শারমিনকে আর কোনো কাজ করতে দেয় না। বলতে গেলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা তাকে জ্বালায়।
জ্বালায়?
জি স্যার।
রাফি জিজ্ঞেস করল, কীভাবে জ্বালায়?
সারাক্ষণ তাকে জিজ্ঞেস করে, গুণ দিলে কত হয়, যোগ দিলে কত হয়—এসব। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।
রাফি একটু হাসল, বলল, এইটা দুনিয়ার নিয়ম। যে যেটা পারে তাকে সবাই সেটা করতে বলে। যে গান গাইতে পারে তাকে সবাই গান গাইতে বলে। যে হাত দেখতে পারে তাকে দেখলে সবাই হাত বাড়িয়ে দেয়! শারমিনকে একটু সহ্য করতে হবে।
সেইটা সমস্যা না।
রাফি একটু অবাক হয়ে বলল, তাহলে কোনটা সমস্যা? শারমিনের বাবা একটু ইতস্তত করে বলল,স্যার, আপনাকে কীভাবে বলি বুঝতে পারছি না। জানাজানি হলে আমার বিপদও হতে পারে—
রাফির কাছে এবার ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হতে থাকে। সে মানুষটির দিকে খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মানুষটি একবার মাথা চুলকালো, তারপর গাল চুলকালো, তারপর নিচু গলায় বলল, স্যার, আমরা যে এই টংঘরগুলো চালাই সেই জন্য আমাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়।