রিয়াজ হাসান নিশীতাকে দেখে একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। নিশীতা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, আপনি নিশ্চয়ই রিয়াজ হাসান।
মানুষটির মুখে বিস্ময়ের ছায়া পড়ে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি রিয়াজ হাসান। আপনাকে চিনতে পারলাম না।
চিনতে পারার কথা নয়–আমি আপনাকে খুঁজে বের করেছি। আমার নাম নিশীতা। আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?
রিয়াজ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, বলল, আসুন।
নিশীতা ঘরের ভিতর ঢুকল, মানুষের বাসায় সাধারণত বাইরের মানুষ এলে বসানোর একটা জায়গা থাকে। এখানে সেরকম কিছু নেই। ঘরটিতে বসার জায়গা নেই–
অনেকগুলো টেবিল এবং সেখানে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। কয়েকটা নানা আকারের কম্পিউটার, সবগুলো খোলা, নানা ধরনের তার দিয়ে জুড়ে দেওয়া রয়েছে।
রিয়াজ একটা চেয়ারের ওপর স্থূপ করে রাখা কাগজপত্র এবং কিছু সার্কিট বোর্ড সরিয়ে নিশীতার বসার জন্য জায়গা করে দিয়ে বলল, বসুন।
নিশীতা ইতস্তত করে বলল, আপনি?
রিয়াজ হাসান চারদিকে একনজর তাকিয়ে অপরাধীর মতো বলল, আসলে আমার এখানে কেউ আসে না, তাই কাউকে বসানোর জায়গা নেই। আপনি বসুন–আমি ভিতর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসি।
রিয়াজ চলে যাবার পর নিশীতা চেয়ারটাতে না বসে ঘরটিতে ইতস্তত হেঁটে বেড়ায়, খুব সতর্ক থাকতে হয় হঠাৎ করে কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দেয়। ঘরের কোনায়। একটি মনিটর রাখা ছিল, তার সামনে যেতেই মনিটরটি হঠাৎ করে আলোকিত হয়ে ওঠে, সেখানে একজন মানুষের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় এবং মানুষটি পরিষ্কার গলায় বলল, কে? কে আপনি?
নিশীতা চমকে উঠে থেমে যায়। কম্পিউটারের মনিটর থেকে কেউ প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না সে ঠিক বুঝতে পারল না। নিশীতা ভালো করে মানুষটির প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল, এটি সত্যিকার মানুষের মুখের ছবি নয়, কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, কম্পিউটার গেমগুলোতে যে ধরনের মানুষের চেহারা দেখা যায় অনেকটা সেরকম, তবে তার থেকে অনেক ভালো। মানুষটির চেহারায় ঠিক বয়স বোঝা যায় না–দশ বছরের বালক হতে পারে, বিশ বছরের যুবক হতে পারে আবার তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের প্রৌঢ়ও হতে পারে। মানুটির চেহারায় একটা সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তি রয়েছে প্রথমে ছিল কৌতূহল এবং নিশীতা দেখতে পেল অভিব্যক্তিটি এখন পুরোপুরি বিরক্তিতে পাল্টে গেছে। মানুষটি বিরক্ত গলার স্বরে বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?
নিশীতা কী করবে বুঝতে পারল না, তখন মনিটর থেকে মানুষের প্রতিচ্ছবিটি অত্যন্ত শক্ত গলায় ধমক দিয়ে বসল, একটা প্রশ্ন করছি সেটা কানে যায় না? কে তুমি?
নিশীতা থতমত খেয়ে বলল, আমি নিশীতা।
নিশীতা? সেটা আবার কী রকম নাম?
নিশীতা অবাক হয়ে মনিটরে মানুষের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইল, সে এর আগে কখনো কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামকে এ রকম স্পষ্ট ভাষায় কথোপকথন করতে শোনে নি। চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি সত্যি সত্যি আমার সাথে কথা বলছ?
মানুষটির মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠল, সত্যি সত্যি নয়তো কি মিথ্যা কথা বলছি? তুমি দেখতে পাচ্ছ না?
তা দেখতে পাচ্ছি। খুবই বিচিত্র।
তুমি সত্যিই মনে কর এটা বিচিত্র?
নিশীতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন রিয়াজ হাসান একটা হালকা চেয়ার নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল, নিশীতাকে মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে হো হো করে হেসে উঠল, বলল, আপনাকে এপসিলন পাকড়াও করছে?
এপসিলন?
নিশীতার কথার উত্তরে মনিটর থেকে মানুষের প্রতিচ্ছবিটি বলল, কেন এপসিলন কি কারো নাম হতে পারে না?
নিশীতা একবার রিয়াজের দিকে আবার একবার মনিটরের দিকে তাকাল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। রিয়াজ ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চেয়ারটা বসিয়ে বলল, এপসিলন আমার ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ কথোপকথন সফটওয়্যার।
নিশীতা কিছু বলার আগেই মনিটর থেকে মানুষটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি বলতে চাও কথোপকথন সফটওয়্যার একটা ফ্যালনা জিনিস?
রিয়াজ গলা উঁচিয়ে বলল, ব্যস এপসিলন, অনেক হয়েছে। এখন চুপ কর।
কেন চুপ করব? আমি কি তোমার খাই না পরি?
বেয়াদব কোথাকার, তোমাকে আমি দেখাচ্ছি মজা বলে রিয়াজ হাসান একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাওয়ার কর্ডটা খুলে নিল।
সাথে সাথে মনিটরে মানুষটির চেহারা চুপসে ছোট হয়ে মিলিয়ে মনিটরটি অন্ধকার হয়ে গেল।
নিশীতা জিভ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, আহা হা–কেন আপনি বেচারাকে টার্মিনেট করে দিলেন! বেশ তো কথা বলছিল।
আপনি চাইলে এর সাথে যত ইচ্ছে কথা বলতে পারেন কিন্তু সে চালু থাকলে আমি কিংবা আপনি কেউই কথা বলতে পারব না!
নিশীতা ঘরের মাঝামাঝি এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি ইংরেজিতে এ রকম কথোপকথন সফটওয়্যার দেখেছি, বাংলায় দেখি নি। কোথায় পেয়েছেন এটা?
কোথায় আবার পাব? আমি লিখেছি।
নিশীতা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে রিয়াজ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি লিখেছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি কমিউনিকেশান্সের লোক।
রিয়াজ স্থির দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছেন মনে হচ্ছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, জি। নিয়ে এসেছি। আমি একজন সাংবাদিক–খোঁজ-খবর নেওয়াই আমার কাজ। আমার ধারণা আমি এখন আপনার সম্পর্কে যেটুকু জানি আপনি নিজেও ততটুকু জানেন না।