- বইয়ের নামঃ পৃ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. আমি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম
আমি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম। আমার মাথার কাছে একটি চতুষ্কোণ স্ক্রিন, সেখানে হালকা নীল রংয়ের আলো, এই আলোটি আমার পরিচিত, কিন্তু কোথায় দেখেছি এখন কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছু একটা ঘটছে এবং আমি জানি ব্যাপারটা ঘটবে কিন্তু সেটি কী আমার মনে পড়ছে না। আমি সেটি মনে করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম। এক সময় আবার আমার চেতনা ফিরে আসতে থাকে এবং আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মাঝামাঝি একটি তরল অবস্থায় আমি ঘুরপাক খেতে থাকি। আমি একরকম জোর করে চোখ খুলে তাকালাম, চতুষ্কোণ স্ক্রিনটিতে একটি নীল গ্রহের ছবি ফুটে উঠেছে। আমি এই গ্রহটিকে চিনি, এর নাম পৃথিবী, ছায়াপথের একটি সাদামাটা নক্ষত্রকে ঘিরে যে গ্রহগুলি ঘুরছে এটি তার তৃতীয় গ্রহ। এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই গ্রহ থেকে এসেছে। আমরা একটি মহাকাশযানে করে এখন আবার এই গ্রহটিতে ফিরে যাচ্ছি।
আমি নীল গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শীত অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে দুই হাত বুকের কাছে টেনে আনতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার সারা দেহে কোনো অনুভূতি নেই। আমার মনে পড়ল মহাকাশযানের দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে আমাকে এবং আমার মতো আরো দশ সহস্র মহাচারীকে শীতল ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর কাছে পৌঁছানোর পর আমাদের জাগিয়ে দেবার কথা। আমরা নিশ্চয়ই গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেছি, তাই আমাদের জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে।
আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম, ধরমর করে উঠে বসার একটা অমানুষিক ইচ্ছাকে প্রাণপনে নিবৃত্ত করে আমি ক্যাপসুলের ভিতরে। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আমার চারপাশে খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, আমি আমার শরীরে আবার শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত এই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুরোপুরি সজীব করার আগে আমাকে এই ক্যাপসুল থেকে বের হতে দেয়া হবে না জেনেও আমি কিছুতেই ভিতরে চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারছিলাম না।
শুয়ে থাকতে থাকতে যখন আমি ধৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেছি ঠিক তখন ক্যাপসুলের ঢাকনাটি সরে গেল। আমি সাথে সাথে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলাম। নিও পলিমারের সূক্ষ্ম একটা আবরণে শরীরকে ঢেকে আমি নগ্ন পদে শীতল মেঝেতে হেঁটে কেন্দ্রীয় ভল্টের বাইরে এসে দাড়ালাম। গোলাকার দরজার কাছে ভাবলেশহীন সুখে একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখে জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, কিহা, শীতল ঘর থেকে তোমার জাগরণ শুভ হোক।
আমি মানুষটার দিকে তাকালাম, এরকম যান্ত্রিক গলায় যে এধরনের একটা। অর্থহীন কথা বলতে পারে সে নিশ্চয়ই মানুষ নয়, সে নিশ্চয়ই একজন রবোট। সে যদি মানুষ নাও হয় তবু তার কথার উত্তরে আমার কিছু একটা বলা উচিৎ কিন্তু আমার অর্থহীন সম্ভাষণ পাল্টা-সম্ভাষণ করার ইচ্ছে করল না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কী পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছি?
মানুষটা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, পৃথিবী?
হ্যাঁ, পৃথিবী।
আমি জানি না।
তুমি কি রবোট?
মানুষটির চোখে এক ধরনের ক্রোধের ছায়া এসে পড়ল। আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি রবোট না মানুষ সেটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটি করতে পারছি কী না তাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে কী দায়িত্ব দেয়া হয়েছে?
আজকে শীতল ঘর থেকে যারা বের হবে তাদের সবার বায়ো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। কমিশনের সামনে হাজির করা।
কিসের কমিশন?
সেটা তুমি সময় হলেই দেখবে।
আমি আবার মানুষটার দিকে তাকালাম, এটি নিশ্চয়ই একটি রবোট, মানুষ হলে যে প্রায় এক শতাব্দী শীতল ঘরে ঘুমিয়ে থেকে জেগে উঠেছে তার সাথে এরকম রুক্ষ গলায় কথা বলত না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চল। তাহলে, আমাকে নিয়ে যাও, যেখানে তোমার নেবার কথা।
মানুষটি বলল, এস।
আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। মানুষটি হেঁটে যেতে যেতে অন্যমনস্ক ভাবে তার ঘাড়ে একবার হাত বুলায়। এটি তাহলে রবোট নয়, মানুষ রবোটকে কখনো। তাদের শরীর চুলকাতে হয় না।
বায়ো নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটি যত জটিল হবে ভেবেছিলাম সেটা মোটেও তত জটিল হল না। চতুষ্কোণ একটা দরজার মতো জায়গা দিয়ে আমাকে নগ্ন দেহে হেঁটে যেতে হল, যন্ত্রটি আমার শরীরকে নানা ভাবে স্ক্যান করে আমার সম্পর্কে সম্ভাব্য সবরকম জৈবিক তথ্য মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে লিপিবদ্ধ করে ফেলল। পুরো তথ্য বিশ্লেষণ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল এবং প্রায় সাথে সাথেই আমার শরীর কয়েক ধরনের প্রতিষেধক দিয়ে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হল। এখানে আমার মস্তিষ্ককে স্ক্যান করা হল, মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করার এই যন্ত্রটি সত্যিই কাজ করে কী না সে ব্যাপারটা আমার বড় ধরনের সন্দেহ রয়েছে। আমার পরিচিত একজন অসাধারণ প্রতিভাবান গণিতবিদ, ব্যক্তিগত জীবনে যে একটু খাপছাড়া ধরনের প্রতিবার এই মস্তিষ্ক স্ক্যান যন্ত্রের সামনে গবেট হিসাবে প্রমাণিত হয়ে এসেছে। এই যন্ত্রটি অবশ্যি আমার সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেছে বলে মনে হল, কারণ যন্ত্রটির পিছনে যে কমবয়সী সুন্দরী মেয়ে কিংবা রবোটটি বসে রয়েছে সে রিপোর্টটি দেখে চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। আমি তার চোখে একধরনের অবিশ্বাসের ছায়া দেখতে পেলাম। আমার চেহারা খুব সাধারণ, মানুষ নিশ্চয়ই অসাধারণ বুদ্ধিমান মানুষকে অসাধারণ সুদর্শন হিসেবে আবিষ্কার করতে চায়।