তৃতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে সত্যিকার অর্থে হতাশাব্যঞ্জক এ রকম কৌতূহলী একটা ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ঠিক কী ঘটেছে সেটা জানার জন্য কারো ভিতর কোনো কৌতূহল নেই। নিশীতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় বড় প্রফেসরদের শরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি, তারা সবাই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। আলোকরশ্মিটি মহাজাগতিক কোনো কিছু হতে পারে কি না জানতে চাইলে বড় বড় প্রফেসররা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়েছেন যেন তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধ প্রফেসর তার কথা শুনে খিকখিক করে হেসে বললেন, রিয়াজ থাকলে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত।
রিয়াজ? নিশীতা জানতে চাইল, রিয়াজ কে?
আমার একজন ছাত্র। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ক্যালটেক থেকে এস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচ.ডি. করে নাসার সাথে কিছুদিন কাজ করেছে। তার কাজকর্ম ছিল মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে। এত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু কাজ শুরু করল সায়েন্স ফিকশান নিয়ে! কী দুঃখের কথা।
নিশীতা নোট বইয়ে রিয়াজ সম্পর্কে তথ্যগুলো টুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, পুরো নাম কী রিয়াজের? কোথায় আছেন এখন?
পুরো নাম যতদূর মনে পড়ে রিয়াজ হাসান। এখন কোথায় আছে জানি না। যেখানে কাজ করত সেখানে ডিরেক্টরের সাথে ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
নিশীতা রিয়াজ হাসান সম্পর্কে যেটুকু সম্ভব তথ্য টুকে নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এল। এমনিতেই সে বাইরের বিজ্ঞানীদের কাছে লিখবে বলে ভেবেছিল, রিয়াজ হাসানকে খুঁজে পেলে সমস্যা অনেকটুকুই মিটে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে নিশীতা অনেক কষ্ট করে রিয়াজ হাসানের একটা ছবি যোগাড় করল। ছাত্র জীবনের ছবি–একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরের কয়েকদিন নিশীতা ইন্টারনেটে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল, পরিচিত সবার কাছে রিয়াজ হাসানের খোঁজ জানতে চেয়ে সে ই-মেইল পাঠিয়ে দিল। জার্নালে বের হওয়া পেপারগুলোতে সে রিয়াজ হাসানের নাম খোজার চেষ্টা করে। তার পুরোনো কর্মস্থলে তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে।
পুরো এক সপ্তাহ অমানুষিক পরিশ্রম করেও রিয়াজ হাসান কোথায় আছে সে সম্পর্কে নিশীতা নতুন কিছুই জানতে পারল না। মানুষটি একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, নাসাতে কাজ করার সময় তথ্য পাঠানোর জন্য নতুন এক ধরনের এনকোডিং বের করেছিল, সেটি ব্যবহার করে ভিন্ন গ্যালাক্সিতে তথ্য পাঠানো যেতে পারে এটুকুই নতুন কিন্তু মানুষটি যেন একেবারে। বাতাসে উবে গেছে।
পরের সপ্তাহে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে একটি সেমিনার বিষয়ে লিখতে গিয়ে নিশীতার মোজাম্মেল হকের সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলতে হল। কাজের কথা শেষ করে মোজাম্মেল হক চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মহাজাগতিক প্রাণীর কী খবর?
নিশীতা হাসার চেষ্টা করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণীর খবর নেবার জন্য যে মানুষটি দরকার তার খবর পাচ্ছি না।
মোজাম্মেল হক ভুরু কুঁচকে বললেন, কে সেই মানুষ?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে মোজাম্মেল হককে রিয়াজ হাসানের কথা বলল। মোজাম্মেল হক পুরোটুকু মন দিয়ে শুনে বললেন, তোমার বয়স কম তাই মানুষের ওপর বিশ্বাস খুব বেশি। আমার ধারণা এই মানুষটিকে খুঁজে পেলেও তোমার খুব একটা লাভ হবে না।
কিন্তু আগে খুঁজে তো পাই!
তুমি যে বর্ণনা দিলে তাতে মনে হল একটু খ্যাপা গোছের মানুষ। তার ওপর ডিরেক্টরের সাথে ঝগড়া করেছে। এই ধরনের মানুষেরা ঝগড়াঝাটি করে সাধারণত দেশে চলে আসে। দেশে এসে এরা একেবারে আলাদাভাবে থাকে–কারো সাথে মেশে না, কিছু করে না।
নিশীতা একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি বলছেন রিয়াজ হাসান এখন দেশে আছে?
তুমি যেহেতু দেশের বাইরে খুঁজে পাও নি আমার ধারণা দেশেই আছে। এক হিসেবে অবশ্য তা হলে খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন।
নিশীতা মাথা নাড়ল, না মোজাম্মেল ভাই। কঠিন নয়। দেশে থাকলে আমি তাকে খুঁজে বের করে ফেলব।
কীভাবে?
সোজা। এ রকম একজন মানুষ যদি দেশে থাকে তা হলে তার একমাত্র যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ইন্টারনেট এ্যাকাউন্ট! দেশের আইএসপিগুলোর কাছে খোঁজ নিলেই বের হয়ে যাবে। আমি বের করে ফেলতে পারব।
মোজাম্মেল হক একটু সন্দেহের চোখে নিশীতার দিকে তাকালেন তার কথা ঠিক বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না।
.
নিশীতা কিন্তু সত্যি সত্যি দুদিনের মাঝে রিয়াজ হাসানকে খুঁজে বের করে ফেলল। তাকে শুরু করতে হয়েছিল একুশ জন রিয়াজ আহমেদকে দিয়ে–এক জন এক জন করে তাদের ছেঁটে ফেলে সত্যিকার রিয়াজ হাসানকে খুঁজে বের করতে হয়েছে।
রিয়াজ হাসানের বাসাটি সত্যি সত্যি তার চরিত্রের সাথে খাপ খেয়ে যায়। বাসার জায়গাটি বেশ বড় গাছগাছালিতে ভরা, কিন্তু সে তুলনায় বাসাটি খুব ছোট, বাইরে থেকে বাসাটি প্রায় দেখাই যায় না। নিশীতা যখন রিয়াজ হাসানের সাথে দেখা করতে এসেছে তখন সন্ধে পার হয়ে গেছে। গেট খুলে খোয়া বাঁধানো পথ দিয়ে হেঁটে বাসার দরজায় শব্দ করল, প্রথমে মনে হল ভিতরে কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর খুট করে শব্দ হল এবং একজন মানুষ দরজা খুলে দাঁড়াল, নিশীতা দেখেই চিনতে পারল, মানুষটি রিয়াজ হাসান। তার কাছে যে ছবিটা রয়েছে তার সাথে অনেক মিল, মাথায় চুল এখনো এলোমেলো, মুখে এখনো এক ধরনের বিষণ্ণতা।