নিশীতা মুখ শক্ত করে বলল, ঠাট্টা করবেন না শ্যামল দা। আপনি যখন বিদেশে টিকটিকি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন আমি তখন সেটা নিয়ে ঠাট্টা করি নি।
শ্যামল গলার স্বর উঁচু করে বলল, আমি টিকটিকি রপ্তানি করার কথা বলি নি–-দুষ্প্রাপ্য সরীসৃপের কথা বলেছিলাম।
একই কথা। যেটা এখানে টিকটিকি সেটা অন্য জায়গায় দুষ্প্রাপ্য সরীসৃপ। উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দেখে মোজাম্মেল হক হাত তুলে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ব্যস, অনেক হয়েছে।
নিশীতা বলল, তা হলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? আমি কি এই এ্যাসাইনমেন্টটা পেতে পারি?
মোজাম্মেল হক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, দেখ নিশীতা, সাংবাদিকতা ব্যাপারটা অনেকটা কোর্টে বিচার করার মত। তুমি যদি মনে কর একটা মানুষ অপরাধী, সেটা কিন্তু যথেষ্ট নয়। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে মানুষটা অপরাধী। এখানেও তাই তুমি যদি মনে কর মহাকাশ থেকে মহাজাগতিক প্রাণী চলে এসেছে, সেটা যথেষ্ট নয়, তোমাকে দেখাতে হবে। ঘটনাটি যত বিচিত্র হবে তোমার দায়িত্ব তত কঠিন। শ্যামল ঠিকই বলেছ। আমরা ট্যাবলয়েড বের করি না!
মোজাম্মেল ভাই– নিশীতা বাধা দিয়ে বলল, আমি কখনোই বলি নি পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য আমি উদ্ভট খবর ছাপাব। এই ঘটনার মাঝে সায়েন্টিফিক রহস্য আছে সেটা আপনারা ধরতে পারছেন না। আমি ধরতে পারছি কারণ আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী, ফিজিক্সে মাস্টার্স করেছি–তারপর সাংবাদিকতায় এসেছি।
বোরহান টিপ্পনী কাটল, সেটাই তোমার সমস্যা। যদি জার্নালিজমের ছাত্রী হতে তা হলে তুমি সাংবাদিকতা করতে, সব জায়গায় সায়েন্স ফিকশান খুঁজে বেড়াতে না।
মোজাম্মেল হক মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। তুমি যদি রিপোর্ট কর স্টক মার্কেট ইনডেক্স দুই পয়েন্ট বেড়েছে কেউ দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে না। কিন্তু তুমি যদি রিপোর্ট করতে চাও একটা কুকুরছানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে তা হলে সেটা সত্যি হলেও কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না। তোমাকে জোর করে সবাইকে বিশ্বাস করাতে হবে।
নিশীতা ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আমি কখনো বলি নি কুকুরছানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে।
শ্যামল বলল, মহাজাগতিক প্রাণী কব্জি কাটা দবিরকে তুলে নিয়ে গিয়েছে আর কুকুরছানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে–এই দুটোর মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই।
মোজাম্মেল হক মাথা নাড়লেন, বললেন, শ্যামল ঠিকই বলেছে। খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবুও তুমি যদি মহাজাগতিক প্রাণীর খোঁজাখুঁজি করতে চাও আমার কোনো আপত্তি নেই, তবে দুটো শর্ত রয়েছে।
নিশীতার রাগে–দুঃখে–অপমানে প্রায় চোখে পানি চলে আসছিল, খুব কষ্ট করে মুখ স্বাভাবিক রেখে বলল, কী শর্ত?।
প্রথম শর্ত হচ্ছে ব্যাপারটা জানাজানি হতে পারবে না। যদি অন্যেরা জেনে যায় আমাদের সাংবাদিকদের আমরা আরিচাঘাটে মহাজাগতিক প্রাণী খুঁজতে পাঠাচ্ছি সেটা আমাদের জন্য সম্মানজনক হবে না। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে তোমার রেগুলার এ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে তারপর এই হাইস্টেক এ্যাসাইনমেন্টে যাবে।
সূক্ষ্ম অপমানে নিশীতার গাল লাল হয়ে উঠল, কষ্ট করে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, ঠিক আছে।
ভেরি গুড। তা হলে তুমি যাও মহিলা পরিষদের আজ একটা বিক্ষোভ মিছিল আছে। সেটা কাভার কর। পতিতা পুনর্বাসনের সরকারি প্রোগ্রামের ওপর আমি একটা ক্রিটিক চাই।
বেশ। নিশীতা উঠে দাঁড়াল। দৈনিক বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথে ভিতরে যে একটা হাসির রোল শুরু হয়ে গেছে ঘর থেকে বের হয়েও সেটা বুঝতে নিশীতার কোনো অসুবিধে হল না। নিশীতার ভিতরে হঠাৎ কেমন জানি একটা জেদ এসে যায়–কে কী বলছে তাতে তার আর কিছুই আসে-যায় না। সে যেভাবেই হোক সত্যটা বের করেই ছাড়বে।
০৩. নিশীতা পরবর্তী কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে
নিশীতা পরবর্তী কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে তিনটি ব্যাপারে নিশ্চিত হল। প্রথম ব্যাপারটি কব্জি কাটা দবিরকে নিয়ে–সে যেন বাতাসে উবে গিয়েছে। অপরাধের অন্ধকার জগতে উপস্থিতিটার গুরুত্ব খুব বেশি, সবাই যেহেতু সবাইকে খুন করে ফেলার চেষ্টা করে কাজেই কাউকে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত দেখলেই ধরে নেওয়া হয় সে খুন হয়ে গেছে, তখন তার রাজত্ব খুব দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যায়। কব্জি কাটা দবিরের বেলাতেও এটা ঘটেছে। তার এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদার বখরা, টেন্ডারের ভাগ সবকিছু তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তার এলাকায় এখন কানা বকুল নামে নতুন একজন মস্তানের আবির্ভাব হয়েছে। কব্জি কাটা দবিরকে নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল নেই।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি সেই রহস্যময় আলোর রেখা নিয়ে–নিশীতা অসংখ্য মানুষের সাথে কথা বলেছে এবং সবার বক্তব্য মোটামুটি একরকম। রাত দুটোর একটু পর পশ্চিম আকাশ থেকে একটা আলোর রেখা ছুটে এসেছে। এটি বজ্রপাত নয়–বজ্রপাতের মতো আঁকাবাকা আলোর ঝলকানি ছিল না–আলোর রেখাঁটি ছিল একেবারে সরলরেখার মতো সোজা। আলোটি ছিল তীব্র এবং উজ্জল, এক পর্যায়ে পুরো এলাকা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের কিছু একটা হতে পারে বড় কোনো উল্কাপাত থেকে কিন্তু এত বড় উল্কা যদি পৃথিবীতে এসে আঘাত করে তার বিস্ফোরণে বিশাল জনপদ ভস্মীভূত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কোনো বড় বিস্ফোরণ ঘটে নি।