একটু আগে যেখানে নীল আলো ছিল এখন সেখানে গাঢ় অন্ধকার, সেখানে রাহেলা তার সন্তানকে বুকে চেপে ধরে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে কিছু অপ্রকৃতিস্থ মূর্তি। মহাকাশযান আর মহাজাগতিক প্রাণী চলে যাবার পর সেগুলো এখন কী করছে কে জানে!
রিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল নিশীতা। রাহেলার কাছে যেতে হবে।
চলুন।
ফ্রেড লিস্টার? ফ্রেন্ড লিস্টার কী করবে এখন?
জানি না। মনে হয় মাথা কুটছে।
কিন্তু ওকে ধরতে হবে না?
ক্যাপ্টেন মারুফ ধরবে। মনে নেই সে কী রকম টাইকোয়ান্ডো জানে! থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট।
ঝোঁপঝাড় কাদা জলা মাটি ভেঙে ওরা সামনে যেতে যেতে হঠাৎ করে প্রেতের মতো মানুষগুলোর একটার মুখোমুখি হল। এর আগে যারা বর্ণনা দিয়েছিল সবাই বলেছে–চোখ দুটো থেকে অন্ধকারের মাঝে লাল আলোর মতো জ্বলতে থাকে, দূরে বসে তারাও দেখেছে, কিন্তু এখন সেই আলো নেই। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ইতস্তত হাঁটছে, তাদের দেখতে পেল বলে মনে হল না, পাশে একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, একবার ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু উঠতে পারল না। একটা পা অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নড়তে থাকল, মনে হতে লাগল শরীরের সাথে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রিয়াজ অকারণেই গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই জম্বিগুলো শেষ হয়ে গেছে, এখন আর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।।
এদের শরীরের ভিতরে ইঁদুরের মতো কী যেন থাকে।
এখন আছে কি না জানি না। থাকলেও আর ভয় নেই।
দুজনে পড়ে থাকা মানুষটিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়, আশপাশে আরো কিছু মূর্তি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ পড়ে গিয়েছে, কেউ কেউ গাছপালায় আটকে গিয়েছে, কেউ কেউ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় এক জায়গায় ঘুরছে। মানুষের মতো এই প্রাণীগুলোর আচরণে এমন একটি অস্বাভাবিকতা রয়েছে যে দেখলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রাণীগুলোকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে তারা রাহেলার কাছে ছুটে গেল।
রাহেলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, শরীরে মুখে ছোপ ছোপ রক্ত। অচেতন হয়েও সে হাত দিয়ে পরম আত্মবিশ্বাসে তার সন্তানকে জড়িয়ে রেখেছে। সন্তানটিও পরম নির্ভাবনায় তার মায়ের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। নিশীতা নিচু হয়ে রাহেলার বুক থেকে সাবধানে শিশুটিকে তুলে নেয়, পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে, শিশুটি ক্ষুধার্ত, মুখ নেড়ে বৃথাই খাওয়ার চেষ্টা করতে করতে তারস্বরে কেঁদে উঠল।
রিয়াজ নিচু হয়ে রাহেলাকে একটু পরীক্ষা করল, বলল, আমাদের এখনই মেডিক্যাল হেল্প দরকার।
নিশীতা বলল, আমি রাহেলার সাথে আছি, আপনি দেখুন কিছু করা যায় কি না।
নিশীতার কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল কেউ একজন টর্চ লাইটের আলো ফেলে ছুটে ছুটে আসছে, কাছে এলে দেখা গেল মানুষটি ক্যাপ্টেন মারুফ। কপালের কাছে কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। রিয়াজ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে আপনার?
ও কিছু না। একজন মিলে চার-পাঁচজনকে ধরতে গেলে ওরকমই হয়।
চার-পাঁচজনকে ধরেছেন?
হ্যাঁ। বেঁধেছেদে রাখতে সময় লাগল। এক বদমাইশের কাছে আবার আর্মস ছিল, তাকে কাবু করতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
কী রকম বাড়াবাড়ি?
মনে হয় ব্যাটার নাকের হাড়টা ভেঙে গেছে। পাঁজরের হাড়ও যেতে পারে দুই-একটা।
নিশীতা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, আপনি একা ঐ মোষের মতো এতগুলো মানুষকে কাবু করেছেন?
আর কাকে পাব! একাই তো করতে হবে।
কীভাবে করলেন আপনি?
রিয়াজ সাহেব যখন আমাকে বললেন আপনাদের প্রকেটশন দিতে তখনই বুঝেছিলাম কাজটা সহজ হবে না। আমাদের মিলিটারি লাইনে একটা কথা আছে যে, অফেন্স ইজ বেস্ট ডিফেন্স। তাই আমি আর দেরি করি নি, পিছন থেকে গিয়ে সবগুলোকে আটক করেছি। খুব কপাল ভালো গুলি করতে হয় নি। দরকার হলে করতাম!
রিয়াজ রাহেলার দিকে তাকিয়ে বলল, রাহেলার মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স দরকার। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।
ক্যাপ্টেন মারুফ চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, বদমাইশগুলোর হেলিকপ্টারটা আছে। পাইলটকে একটু ধোলাই দিতে হয়েছে কিন্তু মনে হয় হেলিকপ্টারটা নিয়ে যেতে পারবে। আমি সাথে থাকব, মাথায় একটা রিভলবার ধরে রাখব–
নিশীতা বলল, মনে হয় তার দরকার হবে না।
কেন?
ঐ দেখেন।
রিয়াজ এবং ক্যাপ্টেন মারুফ তাকিয়ে দেখল, বহুদূর থেকে মশাল জ্বালিয়ে শত শত গ্রামবাসী ছুটে আসছে। হেডলাইট দেখে মনে হয় পিছনে দুই–একটা গাড়িও আসছে। নিশীতা কান পেতে শুনল হেলিকপ্টারের শব্দও শোনা যাচ্ছে। কাঁদের হেলিকপ্টার কে জানে, কিন্তু এখন আর কিছু আসে–যায় না। কিছুক্ষণের মাঝেই এখানে এই এলাকার শত শত মানুষ চলে আসবে। কেউ তখন আর কিছু করতে পারবে না।
১২. নিশীতা ঘর থেকে বের হতেই
নিশীতা ঘর থেকে বের হতেই আম্মা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না। নিশীতা ভান করল সে তার মায়ের চোখের বিস্ময়টুকু লক্ষ করে নি। খুব সহজ গলায় বলল, আম্মা আমি রাত দশটার মাঝে চলে আসব। আম্মা মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, ঠিক আছে। তোর ট্যাক্সি এসেছে?
নিশীতা আবার ভান করল সে মায়ের হাসিটি লক্ষ করে নি; বলল, এসেছে আম্মা?
বাসা থেকে বের হয়ে সে তার মোটর সাইকেলটার দিকে তাকাল, আজকে সে এটাতে উঠবে না। অনেকদিন পর আজকে সে খুব যত্ন করে সেজেছে। রুপালি পাড়ের একটা নীল শাড়ি পরেছে, গলায় নীল পাথর দেওয়া রুপার চোকার, হাতে নীল আর সাদা কাচের চুড়ি, কানে নীল পাথরের দুল। এমনিতেই সে দীর্ঘাঙ্গী, আজ সাদা স্ট্র্যাপের পেন্সিল হিল এক জোড়া স্যান্ডেল পরেছে বলে আরো লম্বা দেখাচ্ছে। রোদে ঘুরে ঘুরে তার ত্বকের একটা রোদে পোড়া সজীবতা আছে, আজ প্রসাধন করে সেটা আড়াল করে কপালে নীল একটা টিপ দিয়েছে। তার চুল খুব লম্বা নয় আজকে সেটাকে ফুলে–ফেঁপে বেঁধে দিয়েছে, একটা বেলি ফুলের মালা পেলে সেটা দিয়ে অবাধ্য চুলগুলোকে শাসন করা যেত। ঘর থেকে বের হবার সময় আয়নায় নিজের চেহারা দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে গেছে, কে জানে তাকে হয়তো সুন্দরী বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়।