ফাইলে রাখব। কখন কী কাজে লাগে কে জানে। মনে হচ্ছে আপনাদের এলাকাটা খুব ইম্পরট্যান্ট হয়ে যাবে।
মানুষগুলোকে এবারে কৌতূহলী দেখা গেল, কমবয়সী মানুষটি জিজ্ঞেস করল, কেন আপা? ইম্পরট্যান্ট কেন হবে?
নিশীতা হাত দিয়ে দূরে পড়ে থাকা জব্বারের মৃতদেহটি দেখিয়ে বলল, ঐ যে দেখেন, মানুষটি কীভাবে মারা গেছে সেটা একটা রহস্য। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, দেখে মনে হয় পুড়ে ঝলসে গেছে, বজ্রপাত হলে যেরকম হয়। কিন্তু কেউ বজ্রপাতের শব্দ শোনে নি। শুনেছেন আপনারা?
না। মানুষগুলো মাথা নাড়ল, কেউ শোনে নি।
নিশীতা মাথা ঘুরে তাকাল, বলল, বজ্রপাত হয় সবচেয়ে উঁচু জায়গায়–এই এখানে উঁচু জায়গা হচ্ছে এই লাইটপোস্ট–বজ্রপাত হলে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ হয়ে যেত, লাইট ফিউজড হত, কিছু হয় নাই। রহস্য এবং রহস্য।
বুড়ো মতন একজন মানুষ বলল, আসলে এই জায়গাটার একটা দোষ আছে।
দোষ?
জে। প্রত্যেক বছর এক জন মানুষ মারা যায়।
এই জায়গায়?
এই আশপাশে। গেল বছর একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিল নজর আলীর ছোট ছেলেকে।
বুড়ো মতন মানুষটি ট্রাকের ধাক্কায় কীভাবে নজর আলীর ছোট ছেলের শরীর থেতলে গেল তার পুখানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে থাকে, শুনে নিশীতার শরীর গুলিয়ে আসতে চায়। নিশীতা তবু ধৈর্য ধরে মুখে আগ্রহ ধরে রেখে বর্ণনাটি শুনতে থাকে, মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য। হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শোনা। নিশীতা লক্ষ করে অন্যেরাও কিছু না কিছু বলতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সে ব্যাগ থেকে ছোট একটা নোট বই বের করে নেয়, সাংবাদিকসুলভ একটি ভাব ফুটিয়ে সেখানে কিছু কিছু জিনিস লিখে রাখার। ভান করতে হবে। মানুষগুলো একটু সহজ হলে কাজও অনেক সহজ হয়ে যায়।
দৈনিক বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের সামনে নিশীতা অধৈর্য মুখে বসে আছে। তার পাশে দৈনিক পত্রিকার আরো দুজন সিনিয়র সাংবাদিক–মোহাম্মদ বোরহান এবং শ্যামল দে। মোজাম্মেল হক হাতের বল পয়েন্ট কলমটি অন্যমনস্কভাবে টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, উঁহু নিশীতা এটা তোমার জন্য নয়।
নিশীতা সোজা হয়ে বসে বলল, কেন নয়?
কব্জি কাটা দবির, কালা জব্বার এই রকম চরিত্রগুলো থেকে পুলিশেরাও দূরে থাকে। তুমি সাংবাদিক–ঠিক করে বললে বলতে হয় মহিলা সাংবাদিক। তোমার আরো বেশি দূরে থাকা দরকার।
নিশীতা মাথা নাড়ল, আমি আপনার সাথে একমত নই মোজাম্মেল ভাই। নিশীতা তার দুই পাশের দুজন সাংবাদিককে দেখিয়ে বলল, বোরহান ভাই কিংবা শ্যামল দা যেটা পারবেন আমিও সেটা পারব।
অবশ্যই পারবে। মোজাম্মেল হক মাথা নেড়ে বললেন, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি জেনেশুনে একটা মেয়েকে খুনি ডাকাত সন্ত্রাসীদের কাছে পাঠাতে পারব না। আমি আমার নিজের মেয়ে হলেও পাঠাতাম না।
নিশীতা বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না মোজাম্মেল ভাই, এই কেসটা খুনি, ডাকাত আর সন্ত্রাসীদের নয়। খুনি, ডাকাত আর সন্ত্রাসীরা মারা পড়েছে, তাদের কাছে আমার আর যেতে হবে না। কেন মারা পড়ছে, কীভাবে মারা পড়ছে আমি সেটা দেখতে চাই। আপনি জানেন গভীর রাতে একটা নীল আলো আকাশ থেকে সোজা নিচে নেমে এসেছিল?
বজ্রপাত।
না, বজ্রপাত না। বজ্রপাতের শব্দ হয় কিন্তু এখানে কোনো শব্দ হয় নি। কালা জব্বারের পোস্টমর্টেম করে দেখা গেছে এস বজ্রপাতে মারা যায় নি।
তা হলে কীভাবে মারা গেছে?
কেউ বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে হার্ট থেমে গেছে। শরীরের ভিতরে বিচিত্র এক ধরনের ক্রিস্টাল পাওয়া গেছে। তার সাথে ছিল কব্জি কাটা দবির–তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তার পায়ের ছাপ সেখানে আছে। রক্তের দাগ আছে, এ ছাড়া মাটিতে বিচিত্র কিছু চিহ্ন আছে। মনে হচ্ছে–
নিশীতা হঠাৎ করে থেমে গেল। মোজাম্মেল হক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, মনে হচ্ছে কী?
মনে হচ্ছে অন্য কোনো একটা প্রাণী এখানে এসেছে।
অন্য কোনো প্রাণী?
হ্যাঁ। একজন ট্রাক ড্রাইভার দেখেছে পানিতে ডুবে থাকা একটা যন্ত্র থেকে একটা প্রাণী বের হয়ে এসেছে।
মোজাম্মেল হক অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হল নিশীতা কী বলছে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। নিশীতার দুই পাশে বসে থাকা দুজন সাংবাদিকের দিকে তিনি একনজর তাকিয়ে আবার নিশীতার দিকে চোখ ফিরিয়ে আনলেন, বললেন, তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না নিশীতা। ওখানে কী হয়েছে বলে তোমার ধারণা?
আমার ধারণা, মহাকাশ থেকে একটা স্পেসশিপ নেমে এসেছে। সেখান থেকে একটা মহাজাগতিক প্রাণী বের হয়ে এসে কালা জব্বারকে খুন করে কব্জি কাটা দবিরকে ধরে নিয়ে গেছে।
নিশীতার দুই পাশে বসে থাকা দুজন এতক্ষণ বেশ কষ্ট করে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছিল, এবারে আর পারল না, হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। বোরহান হাসতে হাসতে বলল, মোজাম্মেল ভাই, চিন্তা করতে পারেন আমাদের দৈনিক বাংলাদেশ পরিক্রমায় বড়। বড় হেডলাইন, মহাজাগতিক প্রাণী কর্তৃক কব্জি কাটা জব্বার অপহরণ!
শ্যামল হাত নেড়ে বলল, সবচেয়ে ভালো হয় পত্রিকাটি হাফ সাইজ করে ট্যাবলয়েড তৈরি করে ফেললে। তা হলে মহাজাগতিক প্রাণীর ইন্টারভিউ পর্যন্ত ছাপতে পারব। সম্পাদকীয় বের হবে, মহাজাগতিক প্রেম : বাংলাদেশের নতুন স্বপ্ন।