রাহেলা জোর করে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখল—ঐ তো দেখা যাচ্ছে তার শিশু সন্তানকে, শুয়ে শুয়ে হাত পা নাড়ছে, কাঁদছে অসহায়ের মতো। রাহেলা আবার ছুটে যেতে থাকে।
মাথার ভিতরে আবার একটা ভোঁতা যন্ত্রণা হয় কিছু একটা ঘটে যায় মাথার ভিতরে, জ্বর হলে যেরকম বিকার হয় ঠিক সেরকম লাগুর্তিার। মনে হয় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে সে, কেউ একজন তাকে ভয় দেখাচ্ছে। কে বলছে ফিরে যেতে। বলছে ফিরে না গেলে তাকে খুন করে ফেলবে, তাকে পুড়িয়ে ফেলবে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। তাকে ধ্বংস করে ফেলবে। রাহেলার হাসি পেক উঠাৎ সে কি মৃত্যুকে ভয় পায়? তাকে ধ্বংস করতে চাইলে করুক। তার যাদুমণিকে, সোনামণিকে বুকে চেপে ধরতে না পারলে সে কি বেঁচে থাকতে চায়? বেঁচে থেকে কী হবে তা হলে?
রাহেলা টলতে টলতে হাঁটতে থাকে। মাথা থেকে কিলবিলে শুড় বের হয়ে আসা দানবগুলো তাকে ঘিরে ধরতে চেষ্টা করছে কিন্তু রাহেলা আজকে থামবে না। আজকে কেউ তাকে থামাতে পারবে না। রাহেলা ছুটতে শুরু করে। কিলবিলে একটা গঁড় দিয়ে তাকে ধরে ফেলে একটা দানব, কী ভয়ঙ্কর শীতল পিচ্ছিল সেই অনুভূতি, রাহেলার সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। চিৎকার করে ঝটকা মেরে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সাথে সাথে আরেকটি দানব তাকে জাপটে ধরে। প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করে নেয়, পিছন থেকে দানবগুলো ছুটে আসছে, তাকে ধরে ফেলছে। চিৎকার করতে করতে ছুটে যায় রাহেলা, পা বেঁধে পড়ে যায় হঠাৎ দানবগুলোর হাত থেকে বিদ্যুতের ঝলক বের হয়ে আসছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপতে থাকে, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে চায়, ভারী একটা লাল পরদা নেমে আসছে চোখের সামনে, নিশ্বাস নিতে পারছে না রাহেলা, মনে হচ্ছে বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসছে পাথরের মতো। রাহেলা বুঝতে পারে সে মরে যাচ্ছে, তাকে মেরে ফেলছে সবাই।
কিন্তু সে মরবে না, তার সোনামণিকে স্পর্শ না করে সে কিছুতেই মরবে না। হাতে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে নিতে থাকে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে থরথর করে কেঁপে কেঁপে সে এগুতে থাকে। তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে তাকে গেঁথে ফেলছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। মুখ দিয়ে দমকে দমকে কাঁচা রক্ত বের হয়ে এল রাহেলার, কিন্তু সে তবু থামল না। নিজেকে টেনে টেনে নিতে থাকল সামনে, এই তো আর মাত্র কয়েক ফুট।
প্রচণ্ড আঘাতে রাহেলা ছিটকে পড়ল, ভয়ঙ্কর আক্রোশে কেউ তাকে আঘাত করেছে, মনে হচ্ছে তার সমস্ত শরীর বুঝি ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছু আসে–যায় না তাতে তার। শরীরের একটা ক্ষুদ্র অংশও যদি বেঁচে থাকে সেটিই এগিয়ে যাবে, স্পর্শ করবে তার সোনামণিকে, তার যাদুকে, তার বুকের ধনকে।
রাহেলা মাটি কামড়ে কামড়ে এগিয়ে গেল, চোখ খুলে দেখতে পেল ভয়ঙ্কর একটি শক্তি, বিচিত্র একটা প্রাণী তাকে থামিয়ে দিতে চাইছে, তাকে শেষ করে দিতে চাইছে কিন্তু পারছে না, কর্কশ শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে রাহেলার, মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে, মনে হচ্ছে তার শরীরকে কেউ মাটির সাথে গেঁথে ফেলছে।
তার মাঝেও সে এগিয়ে গেল, বিন্দু বিন্দু করে এগিয়ে গেল। পৃথিবীর সকল শক্তি, মহাজাগতিক প্রাণীর সমস্ত শক্তি তুচ্ছ করে সে এগিয়ে গেল, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে সে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে সে তার হারিয়ে যাওয়া ছিনিয়ে নেওয়া সন্তানকে জাপটে ধরল।
সাথে সাথে মনে হল তার শরীরের মাঝে হঠাৎ মত্ত হাতির বল এসেছে। পৃথিবীর সব কোলাহল, সব ধ্বনি হঠাৎ করে নীরব হয়ে যায়। হঠাৎ করে সব যন্ত্রণা সব কষ্ট মিলিয়ে যায়। সব অশুভ শক্তি হঠাৎ করে দূরে সরে যায়। রাহেলা গভীর ভালবাসায় তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বুকে টেনে নেয়, গভীর মমতার বুকের মাঝে চেপে ধরে। চারপাশের জগৎ হঠাৎ করে দুলে ওঠে। অশরীরী দানবের মতো মূর্তি, মাথার উপরে বিচিত্র মহাকাশযান, অতিপ্রাকৃত নীল আলো, কোনো কিছুকেই আর সত্যি মনে হয় না, সবকিছু যেন স্বপ্ন। সবকিছুই যেন অর্থহীন। কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। রাহেলা জানে সে আছে এবং তার বুকের মাঝে আছে তার সন্তান। পৃথিবীর কোনো শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো শক্তি তাকে নিতে পারবে না। বুকের মাঝে এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে রাহেলা জ্ঞান হারাল।
.
নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল, তারা এবার একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রিয়াজ নিশীতার হাত স্পর্শ করে বলল, আমরা বেঁচে গেলাম নিশীত।
নিশীতা বুকের ভিতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, এখন কী হবে?
আমার ধারণা মহাকাশযানটি চলে যাবে।
চলে যাবে?
হ্যাঁ।
রিয়াজের কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযানটি কাঁপতে শুরু করে, অত্যন্ত উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ শোনা যায়, নীল আলোটিও হঠাৎ তীব্র হয়ে ওঠে। নিশীতা আর রিয়াজ দেখতে পেল মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করেছে, উপরে উঠতে উঠতে সেটি কয়েক শ মিটার উপরে উঠে গেল, তারপর হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দ করে মহাকাশযানটি আকাশ চিরে উড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আকাশে একটা নীল আলোর রেখা দেখা গেল, তারপর আর কোথাও কিছু নেই। পৃথিবীর বুক থেকে মহাকাশযানটি চিরদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেছে।