নিশীতা চমকে উঠল, রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণী কথা বলছে, সে বলছে তাকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। তার সাথে চুক্তি করা হয়েছে।
কে তোমাকে আমন্ত্রণ করেছে? কে তোমার সাথে চুক্তি করেছে? আমরা সেই চুক্তি মানি না, বিশ্বাস করি না। পৃথিবীর মানুষকে বিপদের মাঝে ফেলে এ রকম চুক্তি করার অধিকার কারো নেই।
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, মানুষ দুর্বল! মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। অক্ষম। ধ্বংসযোগ্য।
নিশীতা চিৎকার করে বলল, কখনো নয়। মানুষ কখনো দুর্বল নয়, আতঙ্কগ্রস্ত নয়। অক্ষম নয়, ধ্বংসযোগ্য নয়। তুমি যে মানুষদের দেখেছ তারা ভীতু, আতঙ্কগ্রস্ত। তারা। অক্ষম। কিন্তু তার বাইরেও মানুষ আছে।
মস্তিষ্ক নিউরন সিনান্স সংযোগ আতঙ্ক ভীতি।
না। নিশীতা জোর দিয়ে বলল, মানুষ মাত্রেই আতঙ্কিত নয়। ভীত নয়।
প্রমাণ। তথ্য যুক্তি।
তুমি প্রমাণ চাও? ঠিক আছে আমি তোমাকে প্রমাণ দেব। ঐ দেখ কমলা রঙের শাড়ি পরে একজন মা তোমাদের কাছে যাচ্ছে। তার সন্তানকে তোমরা নিয়ে গেছ। সেই মা তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। তার মস্তিষ্কের মাঝে ঢুকে দেখ সে ভয় পায় কি না! আমি তোমাকে বলে দিতে পারি একজন সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মা যখন রুখে দাঁড়ায় তার। ভিতরে কোনো ভয় থাকে না, আতঙ্ক থাকে না, কোনো দুর্বলতা থাকে না। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে তুমি এই মাকে থামাও। তোমার সমস্ত শক্তি দিয়েও তুমি তাকে থামাতে পারবে না। তুমি তাকে ধ্বংস করে দিতে পারবে, তুমি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবে, তাকে হত্যা করতে পারবে কিন্তু তুমি তাকে থামাতে পারবে না। সন্তানের জন্য মায়ের বুকের ভিতরে কী ভালবাসার জন্ম হয় তুমি সেটা জান না। তোমার ভিতরে মানুষের অনুভূতি থেকে লক্ষগুণ তীব্র অনুভূতি থাকতে পারে কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। কারণ সন্তানের জন্য মায়ের তীব্র ভালবাসার কাছে তোমার সব অনুভূতি ধুয়ে মুছে যাবে। বানের জলের মতো ভেসে যাবে, ধুলোর মতো উড়ে যাবে!
রিয়াজ নিশীতার হাত স্পর্শ করে বলল, নিশীতা।
নিশীতা নিজেকে সংবরণ করে থামল, রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে, ড. হাসান?
তুমি এখন থামতে পার, নিশীতা।
কেন?
তুমি যে কথাগুলো বলেছ সেটাকে কোডিং করে মহাজাগতিক প্রাণীকে জানানো হয়েছে। মহাজাগতিক প্রাণী সেটা গ্রহণ করেছে।
নিশীতা তীক্ষ্ণ চোখে রিয়াজের দিকে তাকাল, বলল, কী গ্রহণ করেছে?
চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ? কিসের চ্যালেঞ্জ? কে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ?
তুমি দিয়েছ। রাহেলা বনাম মহাজাগতিক প্রাণী
কখন দিলাম?
এই মাত্র!
কী হবে এই চ্যালেঞ্জে?
মহাজাগতিক প্রাণী মুখোমুখি হবে রাহেলার। মানুষের শরীর ব্যবহার করে নয় সত্যি সত্যি। আসল মহাজাগতিক প্রাণী। রাহেলা যদি তাকে পরাজিত করতে পারে তা হলে আমরা বেঁচে যাব। পৃথিবীর মানুষ বেঁচে যাবে।
আর যদি না পারে?
সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করার কেউ থাকবে না নিশীতা।
.
রাহেলা সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, জায়গাটা উঁচু–নিচু, মনে হয় কাটাকুটো আছে। পায়ে খোঁচা লাগছে, হয়তো কেটেকুটে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। দূরে মাটির ওপরে কিছু একটা ভাসছে–শার্টপ্যান্ট পরে থাকা মেয়ে আর চমশা পরা। মানুষটা এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার কিন্তু সে এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। জিনিসটার নিচে নীল আলো, কী বিচিত্র নীল আলো, এ রকম নীল আলো সে কখনো দেখে নি। মনে হচ্ছে জ্যোৎস্নার আলোকে কেউ নীল রং দিয়ে রং করে। দিয়েছে। নীল আলোর নিচে ঐ প্রেতগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে। কে জানে কোথা থেকে। এসেছে এগুলো। দেখতে মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়। দেখলে কী ভয় লাগে! সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে ভয়ে। ভয় আর ঘেন্না–শরীর থেকে শুড়ের মতো কী যেন বের হয়ে আসছে, সেগুলো আবার কিলবিল করে নড়ছে। তার বাচ্চাটিকে ঘিরে রেখেছে এই প্রেতগুলো, এই দানবগুলো, এই রাক্ষসগুলো। কিন্তু রাহেলা ঠিক করেছে আজকে সে ভয় পাবে না। সে ঘেন্নাও করবে না। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে যাবে তার বাচ্চার কাছে, তাকে ধরে শক্ত করে বুকে চেপে ধরবে। তারপর আর কিছু আসে–যায় না। তাকে মেরে ফেললেও আর কিছু আসে–যায় না। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সে তার বাচ্চাটিকে বুকে চেপে ধরে একবার আদর করতে চায়। আর কিছুতে কিছু আসে যায় না।
রাহেলা হঠাৎ এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো এক ধরনের শব্দ কিন্তু সে জানে এটা ঝিঁঝি পোকার ডাক নয়। এটা অন্য কিছু। এই শব্দের সাথে সাথে মাথায় কেমন জানি যন্ত্রণা করে ওঠে। শুধু যন্ত্রণা নয় তার মনে হয় মাথার ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে। হঠাৎ করে রাহেলা কিছু একটা দেখতে পায়। নিঃসীম শূন্য একটা প্রান্তরের মতো একটা কিছু, তার মাঝে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে, বিশাল কিছু আদি নেই অন্ত নেই সেরকম একটা কিছু। প্রচণ্ড আতঙ্কে রাহেলার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। মনে হয় অচেতন হয়ে পড়বে সে।
কিন্তু না, তাকে অচেতন হলে চলবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে, যেভাবেই হোক তাকে জেগে থাকতে হবে। তাকে ভয় পেলেও চলবে না, পৃথিবীর সব ভয়কে এখন তার বুকের ভিতর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে। কাউকে সে ভয় পাবে না–সে যতক্ষণ তার সোনামণিকে বুকে চেপে না ধরবে ততক্ষণ সে পৃথিবীর কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করবে না।