জব্বার গাড়িতে বসে ছিল বলে জানতে পারল না আকাশ থেকে নেমে আসা সেই বিচিত্র মহাকাশযান থেকে একটি বিচিত্র প্রাণী গড়িয়ে গড়িয়ে দবিরের মৃতদেহের কাছে এসে তার বুক চিরে ভিতরে প্রবেশ করেছে। আবার দেখতে পেলেও সম্ভবত নিজের চোখকে বিশ্বাস করত না, কারণ হঠাৎ করে দবিরের চোখ দুটো লাল আলোর মতো জ্বলে উঠল। তার কাটা হাতের ভিতর থেকে একটা যান্ত্রিক হাত গজিয়ে যায় এবং চূর্ণ হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের ভিতর। থেকে ধাতব টিউবের মতো কিছু জিনিস সস শব্দ করে বের হয়ে আসে। দবিরের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে সেটা খানিকটা পশু এবং খানিকটা যন্ত্রের মতো হয়ে যায়, মৃতদেহটি হঠাৎ নড়ে উঠল এবং বিচিত্র একটি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। দবিরের দেহটি খুব সাবধানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ছোট শিশুর মতো পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করে পানির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
জব্বার শেষ পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং টলতে টলতে গাড়ি থেকে বের হয়ে এল। যেখানে দবিরের মৃতদেহটি পড়ে ছিল সেখানে কিছু নেই। জম্বার বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তার যতটুকু অবাক হওয়ার কথা কোনো একটি বিচিত্র কারণে সে ততটুকু অবাক হতে পারছে না। খসখস করে কাছাকাছি একটা শব্দ হল, জব্বার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তার পিছনেই দবির দাঁড়িয়ে আছে। জব্বার রক্তশূন্য মুখে দবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে, দবিরের চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু মনে হচ্ছে মাথা থেকে সাপের মতো কিলবিলে কিছু একটা বের হয়ে এসেছে। সমস্ত শরীরে একটি বিচিত্র ধাতব আবরণ। দবির খুব ধীরে ধীরে তার কাটা হাতটি উঁচু করল, জব্বার দেখতে পেল সেখান থেকে একটি ধাতব হাত বের হয়ে এসেছে, হাতটি সরসর শব্দ করে আরো খানিকটা বের হয়ে আসে এবং হঠাৎ করে তার ভিতর থেকে বিদ্যুৎঝলকের মতো কিছু একটা জব্বারের দিকে ছুটে বের হয়ে এল।
কী হয়েছে জব্বার কিছু বুঝতে পারল না। সমস্ত শরীর কুঁকড়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার শরীর মাটি স্পর্শ করার আগেই তার মৃত্যু ঘটে গেল বলে সে যন্ত্রণাটুকুও অনুভব করতে পারল না। সে বেঁচে থাকলেও তার অমার্জিত, নির্বোধ মস্তিষ্ক ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারত না যে একটি মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীতে এসে নিজের আশ্রয় বেছে নিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিজগৎ হঠাৎ করে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে সেটি বোঝার মতো ক্ষমতা জব্বারের ছিল না।
০২. নিশীতা ক্যামেরা হাতে
নিশীতা ক্যামেরা হাতে এগিয়ে যেতেই পুলিশ হাত উঁচু করে তাকে থামাল, কোথায় যান?
নিশীতা সামনে ভেজা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা জব্বারের মৃতদেহটিকে দেখিয়ে বলল, ছবি তুলব।
পুলিশটি মুখ শক্ত করে বলল, কাছে যাওয়া নিষেধ।
নিশীতা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে পুলিশটির চোখের সামনে দিয়ে নাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, আমি সাংবাদিক। তারপর তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল। পুলিশটি প্রায় হা–হা করে পিছন থেকে ছুটে এল কিন্তু কম বয়সী একটা মেয়েকে ধরে ফেলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না। ততক্ষণে নিশীতা জব্বারের মৃতদেহের কাছে পৌঁছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার ডিজিটাল ক্যামেরায় ঝটপট কয়টা ছবি তুলে নিয়েছে। পুলিশটি কাছে এসে চিৎকার করে বলল, আমি বললাম না, কাছে যাওয়া নিষেধ!
নিশীতা পুড়ে কুঁকড়ে যাওয়া জব্বারের মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষটার নাম কালা জব্বার?
পুলিশটা হাত নেড়ে বলল, আপনাকে আমি কী বললাম?
সাথে কব্জি কাটা দবির ছিল, তাকে পাওয়া গেছে?
সরে যান–সরে যান এখান থেকে।
নিশীতা ক্যামেরাটি দিয়ে ঘ্যাচঘ্যাচ করে পুলিশটির দুটি ছবি তুলে নিল। ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে ফিল্ম খরচ হয় না বলে নিশীতা কখনো ছবি তুলতে কার্পণ্য করে না। পুলিশটি রুষ্ট হয়ে বলল, কী হল? আমার ছবি তুলছেন কেন?
পত্রিকায় নিউজ হবে। সাংবাদিক হয়রানি।
সাংবাদিক হয়রানি?
হ্যাঁ। সাংবাদিক হয়রানি এবং তথ্য গোপন। এটা স্বাধীন দেশ–স্বাধীন দেশে কোনো তথ্য গোপন রাখা যাবে না।
পুলিশটি মাথা নেড়ে বলল, আমি এত কিছু জানি না– আমাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে কেউ যেন কাছে না আসে। যদি কথা বলতে চান তা হলে বড় সাহেবের সাথে কথা বলবেন।
বলবই তো। অবশ্যই বলব– বলে নিশীতা মুখ গম্ভীর করে এগিয়ে গেল, তবে পুলিশের বড় সাহেবের কাছে নয়–দূরে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের কাছে। কাল রাতে এই এলাকায় বিদ্যুঝলকের মতো একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখা গেছে বলে শোনা যাচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল–বজ্রপাত তো হতেই পারে। তবে আলোর ঝলকানিটি নাকি বজ্রপাতের মতো ছিল না, সোজা আকাশ থেকে একটা সরলরেখার মতো নিচে নেমে এসেছে।
নিশীতাকে হেঁটে আসতে দেখে জটলা পাকানো মানুষগুলো একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। নিশীতার আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে–সে যখন মোটর সাইকেলে করে শার্টপ্যান্ট পরে ছুটে বেড়ায় অনেকেই নড়েচড়ে দাঁড়ায়, ভুরু কুঁচকে তাকায়।
নিশীতা কাছে গিয়ে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে দাঁড়াল, আপনাদের একটা ছবি তুলতে পারি?
মানুষগুলোর অনেকের মুখে হাসি ফুটে উঠল। কী কারণ কে জানে ছবি তোলার কথা বললেই মানুষ খুশি হয়ে ওঠে। কমবয়সী একজন জিজ্ঞেস করল, কী করবেন ছবি দিয়ে?