আমার কথা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে।
ঠিক আছে। তুমি এক ঘণ্টা পর হোটেল সোনারগাঁওয়ে যাও, সেখানে রিয়াজ হাসানকে পাবে।
চমৎকার।
তুমি নিশ্চয়ই জান, এই ব্যাপার নিয়ে তুমি উল্টাপাল্টা কিছু করলে তার ফল হবে ভয়ানক।
আমি জানি। নিশীতা ফিসফিস করে বলল, খুব ভালো করে জানি।
ফার্মগেটের কাছে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ নিশীতা শুনতে পেল তার সেলুলার টেলিফোনটি শব্দ করছে–কেউ একজন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। অন্য কোনো সময় হলে সে টেলিফোনটি নিয়ে মাথা ঘামাত না, যে চেষ্টা করছে সে এক ঘণ্টা পরেও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে কিন্তু এখন নিশীতা কোনো ঝুঁকি নিল না। মোটর সাইকেল থামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিশীতা তার টেলিফোনটি কানে লাগাল, হালো।
নিশীতা?
কথা বলছি।
নিশীতা, খুব সাবধান। একটা নীল মাইক্রোবাসে করে কিছু মানুষ তোমার পিছু পিছু আসছে।
আপনি কে?
তুমি জান আমি কে।
এপসিলন! তুমি এপসিলন।
আমি এপসিলনকে ব্যবহার করছি।
নীল মাইক্রোবাসে কারা আছে?
ফ্রেড লিস্টারের মানুষ।
তারা কী করতে চায়?
তোমাকে খুন করতে চায়। এরা খুব ভয়ঙ্কর মানুষ নিশীতা।
ঠিক আছে, আমি দেখছি।
টেলিফোনটা ব্যাগে রেখে নিশীতা পিছনে তাকাল, এখনো কোনো নীল মাইক্রোবাস দেখা যাচ্ছে না। নিশীতা প্রথমবার এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সত্যি সত্যি যদি ফ্রেড লিস্টারের মানুষ তাকে খুন করার চেষ্টা করে তা হলে সে কী করবে? এই মুহূর্তে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এটি নিয়ে ভেবে সে কোনো সমাধান বের করতে পারবে না। নিশীতা আবার মোটর সাইকেলে চেপে বসল, স্টার্ট দিয়ে এক মুহূর্তে রাস্তার ভিড়ের মাঝে মিশে গেল।
হোটেল সোনারগাঁওয়ে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে নিশীতা দেখল তার খুব কাছাকাছি একটা নীল রঙের মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে ঝুঁকে একজন মানুষ বের হয়ে আছে, মানুষটি কী করছে সে দেখতে পেল না কিন্তু হঠাৎ তার ঘাড়ে তীক্ষ্ণ সুঁচ ফোঁটার মতো একটা যন্ত্রণা হল। নিশীতা ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখে সেখানে ছোট কাচের সিরিঞ্জের মতো একটি এল বিধে আছে, সেটাকে টেনে বের করে আনতেই হঠাৎ তার মাথা ঘুরে গেল, কোনো একটা বিষাক্ত ওষুধ তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিশীতা কোনো ভাবে তার মোটর সাইকেলটা থামাল, কিন্তু সেখান থেকে নামতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল। নিশীতা শুনতে পায় তার আশপাশে অসংখ্য গাড়ির হর্ন বাজছে, ব্রেক কষে থামার চেষ্টা করছে। নিশীতা চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করে, দেখতে পায় নীল মাইক্রোবাসটি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, জানালার কাছে বসে থাকা মানুষটা মুখে এক ধরনের বিচিত্র হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দেখতে দেখতে তাকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেল, তাকে কিছু একটা বলছে সে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু উত্তরে কিছু বলতে পারছে না। নিশীতা দেখল ঠিক পিছনে একটা জিপ এসে থেমেছে সেখান থেকে দুজন মানুষ নেমে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
নিশীতার পাশে উবু হয়ে বসে থাকা একজন মানুষ বলল, জানি না। হঠাৎ করে মোটর সাইকেল থামিয়ে পড়ে গেলেন।
মনে হয় ডায়াবেটিক শক। কিংবা হার্ট এ্যাটাক–দেখি সবাই সরে যান, একটু বাতাস আসতে দিন।
মানুষজন সরে লোকটাকে জায়গা করে দিল, নিশীতা চিনতে পারল এই মানুষটাকে সে রিয়াজ হাসানের বাসায় দেখেছে। নিশীতা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল মানুষটি এসে তার হাত ধরে পালস গোনার ভান করল, চোখের পাতা টেনে দেখল, তারপর সোজা হয়ে পঁড়িয়ে বলল, একে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।
উপস্থিত লোকজনের ভিতর থেকে একজন বলল, কেমন করে নেব? এম্বুলেন্স?
মানুষটি বলল, আমি হাসপাতালে পৌঁছে দেব, একে গাড়িতে তুলে দিন।
নিশীতা চিৎকার করে বলতে চাইল, না–আমাকে এদের হাতে দিও না, কিন্তু সে একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারল না। নিশীতাকে ধরাধরি করে গাড়ির পিছনের সিটে শুইয়ে দেবার পর মানুষটি উপস্থিত মানুষদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের কেউ সাথে যেতে চান?
একজন বলল, ঠিক আছে আমিও সাথে যাই।
নিশীতা চোখ ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখল, এই মানুষটিও তাদের দলের একজন, সবাইকে নিয়ে এখানে পুরোপুরি একটা নাটকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিশীতা বুঝতে পারে খুব ধীরে ধীরে সে অচেতন হয়ে পড়ছে। তার মাঝে টের পেল তার মোটর সাইকেলটাকেও পিছনে তোলা হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মাঝে জিপটা ছেড়ে দিল, নিশীতা শুনতে পেল একজন উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বলল, চমৎকার অপারেশন। একেবারে নিখুঁত।
একজন নিশীতার ওপর ঝুঁকে পড়ে গলায় শ্লেষ এনে বলল, সাংবাদিক সাহেবা– আপনি কি এখনো জেগে আছেন??
নিশীতা চোখ খুলে তাকাল, মানুষটি কুৎসিত একটা ভঙ্গি করে বলল, পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে …।
.
নিশীতার মনে হল অনেক দূর থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে। সে সাবধানে চোখ খুলে তাকাল, সত্যি সত্যি তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কোনো একজন মানুষ তাকে কোমল গলায় ডাকছে। নিশীতা মানুষটিকে চিনতে পারল, রিয়াজ হাসান।
সে চমকে উঠে বসার চেষ্টা করতেই মনে হল তার মাথার ভিতরে কিছু একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণার একটা শব্দ করে সে আবার শুয়ে পড়ল। রিয়াজ হাসান বলল, কেমন আছ নিশীতা?